
ছবি: সংগৃহীত
থানার ওসি (অফিসার ইনচার্জ) পদে পদায়নের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ পুলিশ এক যুগান্তকারী নীতিমালা প্রণয়নের পথে এগিয়ে যাচ্ছে। খসড়া এই নীতিমালায় ওসি হিসেবে নিয়োগে একাধিক কঠোর শর্ত আরোপের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে, যা মাঠপর্যায়ের পুলিশি কার্যক্রমে শৃঙ্খলা, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা প্রতিষ্ঠায় একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হিসেবে দেখা হচ্ছে।
নতুন নীতিমালায় বলা হয়েছে, বয়স ৫৪ বছরের বেশি হলেই কোনো পুলিশ কর্মকর্তাকে ওসি হিসেবে পদায়ন করা যাবে না। পাশাপাশি চাকরিজীবনে তিনবার গুরুদণ্ডপ্রাপ্ত কেউ ওসি হবেন—এমন কোনো সুযোগ থাকবে না। গুরুদণ্ড বলতে চাকরি থেকে বরখাস্ত, অপসারণ, পদাবনতি, বেতন বৃদ্ধি বা পদোন্নতি স্থগিতের মতো শাস্তিকে বোঝানো হয়েছে।
এই খসড়া নীতিমালাটি ২০২৫ সালের ১৬ এপ্রিল অনুষ্ঠিত বাংলাদেশ পুলিশের পলিসি গ্রুপের এক সভায় উত্থাপন করা হয়। উক্ত সভায় ২৮টি শর্ত নিয়ে থানার ওসি এবং ২১টি শর্ত নিয়ে পুলিশ পরিদর্শক পদে পদায়নের প্রস্তাবনা নিয়ে বিশদ আলোচনা হয়।
সীমাবদ্ধতা ও সময়সীমা: একজন ওসি সর্বোচ্চ ৮ বছর বা চারটি থানা পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করতে পারবেন
প্রস্তাবিত নীতিমালায় বলা হয়েছে, একজন পুলিশ কর্মকর্তাকে ওসি হিসেবে সর্বোচ্চ চারটি থানায় বা সর্বমোট আট বছর পর্যন্ত পদায়ন করা যাবে (যেটি আগে পূর্ণ হয়)। একবার ওসি হিসেবে দায়িত্ব পালনের পর তিনি আর সেই একই থানায় দ্বিতীয়বার নিয়োগ পেতে পারবেন না। এমনকি কোনো থানায় টানা সর্বোচ্চ তিন বছরের বেশি ওসি থাকা যাবে না এবং দুই বছরের বেশি থাকলে তাকে অন্যত্র বদলি করা হবে।
কোনো ওসিকে দেড় বছরের আগে যদি বদলি করতে হয়, তবে তার জন্য পুলিশ সদর দপ্তরের অনুমতি বাধ্যতামূলক করা হচ্ছে। এছাড়া অব্যবহিত পূর্বের কর্মস্থল, জেলা পুলিশ বা একই ইউনিটে পুনরায় ওসি পদে নিয়োগ দেওয়া যাবে না।
প্রশিক্ষণ ও গোপনীয় মূল্যায়ন রিপোর্টে (ACR) উচ্চমান অর্জন অপরিহার্য
নতুন নীতিমালায় বলা হয়েছে, ওসি হিসেবে নিয়োগ পেতে হলে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাকে অবশ্যই পুলিশ স্টেশন ম্যানেজমেন্ট কোর্স (PSMC) সম্পন্ন করতে হবে। শুধু তাই নয়, তার প্রশিক্ষণ ফলাফল হতে হবে সন্তোষজনক। পাশাপাশি বিগত পাঁচ বছরের গোপনীয় বার্ষিক মূল্যায়ন প্রতিবেদনে (Annual Confidential Report - ACR) অন্তত ৮০ নম্বর থাকতে হবে।
আরও বলা হয়েছে, সর্বশেষ তিন বছরের ACR-এ কোনো ‘বিরূপ মন্তব্য’ থাকলে তাকে ওসি হিসেবে পদায়ন করা যাবে না।
‘ফিটলিস্ট’ ছাড়া ওসি হওয়া যাবে না, সিলেকশন বোর্ড করবে যাচাই
ওসি পদে নিয়োগের জন্য একটি বিশেষ ‘ফিটলিস্ট’ তৈরি করবে পুলিশ সদর দপ্তর। এই ফিটলিস্টে থাকা পরিদর্শকদের মধ্য থেকে নির্বাচিতদেরই ওসি হিসেবে পদায়ন করা যাবে। এ কাজে গঠন করা হবে একটি ছয় বা ততোধিক সদস্যবিশিষ্ট ‘সিলেকশন বোর্ড’। এর সভাপতি হবেন অতিরিক্ত আইজি (প্রশাসন) এবং সদস্য সচিব হবেন পার্সোনাল ম্যানেজমেন্ট শাখার (PM-2) একজন কর্মকর্তা।
পরিদর্শকদের জন্যও কড়াকড়ি নিয়ম
পুলিশ পরিদর্শক (নিরস্ত্র) পদে যিনি পদোন্নতি পাবেন, তাকে প্রথমে তার পদোন্নতি পাওয়া ইউনিটেই দায়িত্ব পালন করতে হবে। সেই সঙ্গে কমপক্ষে তিন বছর নিরস্ত্র পরিদর্শক পদে দায়িত্ব পালনের অভিজ্ঞতা না থাকলে তাকে ফিটলিস্টে অন্তর্ভুক্ত করা যাবে না।
এইচএসসি বা সমমান শিক্ষাগত যোগ্যতা থাকতে হবে। কোনো পুলিশ কর্মকর্তা পরিদর্শক থাকা অবস্থায় অর্থনৈতিক দুর্নীতি বা নৈতিক স্খলনের কারণে গুরুদণ্ডপ্রাপ্ত হলে, তিনি ওসি হওয়ার জন্য ফিটলিস্টে অন্তর্ভুক্ত হতে পারবেন না।
এছাড়া কোনো পরিদর্শককে ধারাবাহিকভাবে একই থানার ওসি হিসেবে নিয়োগ দেওয়া যাবে না। তবে তিনি যদি অন্য কোনো ইউনিটে অন্তত ছয় মাস চাকরি করে থাকেন, তবে সেই থানায় ফের ওসি হতে পারেন।
জেলা বা রেঞ্জভিত্তিক চাকরির সময়সীমা
খসড়া নীতিমালায় বলা হয়েছে, কোনো পুলিশ কর্মকর্তা একই জেলায় টানা তিন বছরের বেশি এবং একই রেঞ্জ বা ইউনিটে (পুলিশ সদর দপ্তর ও র্যাব বাদে) টানা ছয় বছরের বেশি চাকরি করতে পারবেন না। এই নিয়ম পরিদর্শক (সশস্ত্র) এবং (ট্রাফিক) পদেও সমানভাবে প্রযোজ্য হবে।
বাস্তবায়নের আগে পুনর্বিবেচনার সুযোগ
প্রাথমিকভাবে খসড়া নীতিমালায় ৫২ বছরের ঊর্ধ্বে কোনো কর্মকর্তাকে ওসি হিসেবে নিয়োগ না দেওয়ার প্রস্তাব রাখা হলেও, পলিসি গ্রুপের অধিকাংশ সদস্য সেটি বাতিল করেছেন এবং বয়সসীমা ৫৪ বছর পর্যন্ত রাখার বিষয়ে একমত পোষণ করেছেন।
বাংলাদেশ পুলিশের অতিরিক্ত আইজি (চলতি দায়িত্বে) আবু নাসের মো. খালেদ জানান, “এই নীতিমালা নিয়ে আমরা বিস্তারিত আলোচনা করেছি। এখনো সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত হয়নি। আরও সভা হবে এবং সেখানেই চুলচেরা বিশ্লেষণের পর এ বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।”
ওসি পদে নিয়োগের ক্ষেত্রে এ ধরনের কঠোর ও সুস্পষ্ট নীতিমালা মাঠপর্যায়ে পুলিশি কার্যক্রমে কাঙ্ক্ষিত শৃঙ্খলা ও পেশাদারিত্ব আনতে কার্যকর ভূমিকা রাখবে বলে আশা করা হচ্ছে। একদিকে এটি যেমন যোগ্য কর্মকর্তাদের অগ্রাধিকার নিশ্চিত করবে, অন্যদিকে তেমনি রাজনৈতিক বা ব্যক্তিগত প্রভাবমুক্ত একটি নিয়োগ প্রক্রিয়ার ভিত্তি স্থাপন করবে।
সূত্র: বাংলাদেশ পুলিশ, পলিসি গ্রুপ সভা নথিপত্র, অভ্যন্তরীণ মেমো, গণমাধ্যম প্রতিবেদন
বাংলাবার্তা/এমএইচ