
ছবি: সংগৃহীত
রাজধানীসহ সারাদেশে আওয়ামী লীগের সাম্প্রতিক রাজনৈতিক তৎপরতা এবং হঠাৎ করে উদ্ভূত ঝটিকা মিছিল নিয়ে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ঘোলাটে হয়ে উঠেছে বলে মনে করছেন নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা। এ প্রেক্ষাপটে শনিবার (১৯ এপ্রিল) রাজধানীর বিমানবন্দর থানা পরিদর্শনকালে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে কঠোর নির্দেশনা দিয়েছেন সরকারের স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী। তিনি স্পষ্ট ভাষায় বলেছেন, “ভবিষ্যতে যেন আওয়ামী লীগ আর কোনো মিছিল করতে না পারে, সে বিষয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে বলা হয়েছে।”
নতুন রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট ও মিছিল আতঙ্ক
গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকার পতনের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশে এক নতুন রাজনৈতিক যুগের সূচনা ঘটে। দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকা আওয়ামী লীগ এই মুহূর্তে সাংগঠনিকভাবে বিপর্যস্ত। তবে সম্প্রতি রাজধানীসহ বিভিন্ন জেলায় দলটির কিছু নেতাকর্মী ফের রাজনৈতিক মাঠে সক্রিয় হওয়ার চেষ্টা করছেন। তারা বিভিন্ন স্থানে ছোট ছোট ঝটিকা মিছিল করে নিজেদের উপস্থিতি জানান দেওয়ার চেষ্টা করছেন। এসব মিছিল জনমনে একধরনের অস্বস্তি ও আতঙ্কের জন্ম দিয়েছে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, ২০০৭ সালের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে প্রথমবারের মতো এত সুসংগঠিতভাবে নিষেধাজ্ঞা ও বিচারের দাবি উঠেছে। গত জুলাই মাসে সংঘটিত ব্যাপক গণআন্দোলনের সময় যেসব সহিংসতা ও হত্যাকাণ্ড ঘটেছে, তার দায় সরকার এবং আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের ওপর চাপিয়ে বিচার দাবি করছে জনগণের একটি বড় অংশ।
রাজনৈতিক নিষেধাজ্ঞা ও বিচার দাবি
শুধু সোশ্যাল মিডিয়া বা সুশীল সমাজ নয়, এখন রাস্তায়ও আওয়াজ উঠছে আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করার জন্য। শুক্রবার রাজধানীর উত্তরাসহ দেশের একাধিক স্থানে ‘আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ করো’ স্লোগানে বিক্ষোভ মিছিল করেছে বিভিন্ন রাজনৈতিক ও নাগরিক প্ল্যাটফর্ম। এসব মিছিলে সরকারকে উদ্দেশ করে বলা হয়েছে, যদি গণহত্যার বিচার না হয়, তাহলে আগামী দিনে রাজপথে গণপ্রতিরোধ গড়ে তোলা হবে।
এই পটভূমিতে শনিবারের পুলিশ থানা পরিদর্শনকালে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার দেওয়া বক্তব্য বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। তিনি শুধু সাধারণ পরিদর্শনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকেননি, বরং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে একটি নির্দিষ্ট রাজনৈতিক দলের বিরুদ্ধে কার্যকর ও লক্ষ্যভিত্তিক ব্যবস্থা নেওয়ার সরাসরি নির্দেশনা দিয়েছেন।
চারটি থানায় পর্যবেক্ষণ
বিমানবন্দর থানায় সকাল ১১টা ১০ মিনিটে পৌঁছে থানার কার্যক্রম পর্যালোচনা করেন স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা। পরে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন তিনি। সেখানে তিনি বলেন, “আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি অস্থিতিশীল করতে যারা নিষিদ্ধ রাজনৈতিক দলটির নাম ব্যবহার করে মাঠে নামার চেষ্টা করছে, তাদের ঠেকাতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে সরাসরি পদক্ষেপ নিতে হবে।”
এদিন শুধু বিমানবন্দর থানা নয়, আরও তিনটি থানায় পরিদর্শন করেন তিনি। এগুলো হলো—উত্তরা পশ্চিম, উত্তরা পূর্ব ও তুরাগ থানা। প্রত্যেক থানাতেই পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করে নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার এবং আওয়ামী লীগের মিছিল প্রতিরোধে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দিয়েছেন।
নিরাপত্তা কৌশলে রদবদল
সূত্র জানায়, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে একাধিক বৈঠকে মিছিল প্রতিরোধ, গোয়েন্দা নজরদারি জোরদার, সন্দেহভাজন রাজনৈতিক তৎপরতাকারীদের তালিকা প্রণয়ন, রাজনৈতিক কর্মসূচির আগেই এলাকায় অভিযান চালানো এবং যেকোনো ঝটিকা মিছিলকে শক্তভাবে প্রতিহত করার কৌশল নির্ধারণ করা হয়েছে।
স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার এমন কড়া অবস্থানকে অনেকেই দেখছেন বর্তমান প্রশাসনের আইনশৃঙ্খলা রক্ষার প্রতি কঠোর অঙ্গীকার হিসেবে। বিশেষ করে কোনো ধরনের রাজনৈতিক পুনর্জাগরণ বা অস্থিরতা যাতে শুরু না হয়, সে দিকেই মূল নজর দেওয়া হয়েছে।
বিশ্লেষকদের প্রতিক্রিয়া
রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা বলছেন, সরকার যেহেতু এখন একটি শান্তিপূর্ণ এবং কার্যকর প্রশাসনিক রূপ দিতে চায়, তাই সাবেক রাজনৈতিক শক্তির যেকোনো ধরনের পুনরুত্থানকে তারা জাতীয় নিরাপত্তার হুমকি হিসেবে বিবেচনা করছে। এ কারণেই প্রশাসন ‘জিরো টলারেন্স’ নীতিতে যাচ্ছে।
একজন অবসরপ্রাপ্ত পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, “আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কখনোই একটি নির্দিষ্ট দলের ওপর নিষেধাজ্ঞা কার্যকর করতে ব্যবহৃত হয় না। কিন্তু যদি সেই দল জাতীয় নিরাপত্তা ও শান্তি বিঘ্নিত করে, তাহলে ব্যবস্থা নেওয়াটাই দায়িত্বের অংশ হয়ে পড়ে।”
বাংলাবার্তা/এমএইচ