
ছবি: সংগৃহীত
আন্তর্জাতিক পুলিশ সংস্থা ইন্টারপোলের কাছে বাংলাদেশ থেকে পাঠানো এক ব্যতিক্রমধর্মী আবেদন নিয়ে রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক মহলে ব্যাপক চাঞ্চল্য সৃষ্টি হয়েছে। এবার রীতিমতো সাংবিধানিক ও প্রশাসনিক ক্ষমতার শীর্ষে থাকা ব্যক্তিদের নাম অন্তর্ভুক্ত করে মোট ১২ জনের বিরুদ্ধে ‘রেড নোটিশ’ জারির জন্য আবেদন করেছে বাংলাদেশ পুলিশের ন্যাশনাল সেন্ট্রাল ব্যুরো (এনসিবি)। তালিকায় রয়েছেন বর্তমান আওয়ামী লীগ সভাপতি ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, দলটির সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালসহ একাধিক প্রভাবশালী সাবেক মন্ত্রী ও আমলা।
তিন ধাপে রেড নোটিশ আবেদনের উদ্যোগ
পুলিশ সদর দপ্তরের সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, রেড নোটিশ জারির লক্ষ্যে ইন্টারপোলের কাছে পৃথক তিনটি ধাপে আবেদন পাঠানো হয়েছে। প্রথম ধাপে চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে সাবেক আইজিপি বেনজীর আহমেদের বিরুদ্ধে আবেদন করা হয়। এরপর ১০ এপ্রিল দ্বিতীয় ধাপে আরও ১০ জনের বিরুদ্ধে আবেদন পাঠানো হয়। এ তালিকায় শেখ হাসিনা ও বেনজীর বাদে আরও রয়েছেন:
ওবায়দুল কাদের (সাবেক সেতুমন্ত্রী ও দলীয় সাধারণ সম্পাদক)
আসাদুজ্জামান খান কামাল (সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী)
আ ক ম মোজাম্মেল হক (সাবেক মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী)
হাছান মাহমুদ (সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী)
জাহাঙ্গীর কবির নানক (সাবেক বস্ত্র ও পাটমন্ত্রী)
মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল (সাবেক শিক্ষামন্ত্রী)
শেখ ফজলে নূর তাপস (ডিএসসিসির সাবেক মেয়র)
মেজর জেনারেল (অব.) তারিক আহমেদ সিদ্দিক (প্রধানমন্ত্রীর সাবেক প্রতিরক্ষা উপদেষ্টা)
নসরুল হামিদ (সাবেক বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী)
মোহাম্মদ আলী আরাফাত (সাবেক তথ্য প্রতিমন্ত্রী)
তৃতীয় ধাপে আরও কিছু নাম অন্তর্ভুক্ত করার চিন্তা-ভাবনা থাকলেও এখনো সেই উদ্যোগ আনুষ্ঠানিক হয়নি।
প্রসিকিউশন ও আদালতের সুপারিশে পদক্ষেপ
রেড নোটিশ জারির প্রক্রিয়া সাধারণত কোনো অভিযুক্ত ব্যক্তি যদি বিদেশে পলাতক থাকেন এবং তার বিরুদ্ধে বাংলাদেশে আদালত থেকে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি থাকে, তখনই তা করা হয়। এ ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটরের কার্যালয় থেকে সুপারিশের ভিত্তিতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও পুলিশ সদর দপ্তরে আনুষ্ঠানিকভাবে আবেদন পাঠানো হয়।
সূত্র জানিয়েছে, শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে এই প্রক্রিয়া শুরু হয় ২০২৩ সালের নভেম্বরে, যখন তাকে গ্রেফতার করতে ইন্টারপোলে ‘রেড অ্যালার্ট’ জারির সুপারিশ পাঠানো হয়। তখন বিষয়টি প্রশাসনিক আলোচনার পর্যায়ে থাকলেও চলতি বছর বিষয়টি আরও এগিয়ে নেয় এনসিবি।
আইনি ভিত্তি ও পরবর্তী পদক্ষেপ
ইন্টারপোলে রেড নোটিশ জারি হওয়া মানে কোনো আন্তর্জাতিক গ্রেফতারি পরোয়ানা নয়। এটি মূলত সদস্য দেশগুলোর মধ্যে একধরনের পুলিশি সহযোগিতার সিগন্যাল, যার ফলে পলাতক ব্যক্তির অবস্থান শনাক্ত, আটকের পর আটকাদেশ প্রক্রিয়া শুরু ও সম্ভাব্য প্রত্যর্পণের প্রক্রিয়া এগিয়ে নেওয়া যায়।
রেড নোটিশ জারির আবেদনে যুক্ত প্রতিটি নামের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের আদালত থেকে জারি হওয়া ওয়ারেন্টের অনুলিপি, মামলার সুনির্দিষ্ট বিবরণ, অভিযুক্তের সম্ভাব্য অবস্থান, পাসপোর্ট নম্বর ও অন্যান্য বায়োমেট্রিক তথ্য যুক্ত করে পাঠানো হয়েছে।
শেখ হাসিনার ভারতে অবস্থান ও রাজনৈতিক উত্তাপ
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, গত বছরের ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা গোপনে ভারতে চলে যান এবং এখনো সেখানেই অবস্থান করছেন। ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের বন্দি প্রত্যর্পণ চুক্তি থাকায়, রেড নোটিশ জারি হলে তাকে ফেরত আনার আইনি সুযোগ তৈরি হতে পারে।
তবে এ বিষয়ে এখনো ভারত সরকারের অবস্থান স্পষ্ট নয়। ভারতের আদালত এবং স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সম্মতি ছাড়া শেখ হাসিনাকে ফেরত পাঠানো সম্ভব হবে না। এই প্রক্রিয়া নির্ভর করবে দুই দেশের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক ও রাজনৈতিক সমঝোতার ওপর।
মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগ
সবচেয়ে বিস্ময়কর দিক হলো, শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধে জড়িত থাকার অভিযোগে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে একটি মামলা চলমান রয়েছে। চিফ প্রসিকিউটর জানিয়েছেন, তদন্ত প্রায় শেষ পর্যায়ে এবং রোববার (২০ এপ্রিল) এ মামলায় তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করা হতে পারে।
অনুরূপভাবে অন্য ১১ জনের বিরুদ্ধেও নানা অভিযোগ ও মামলার পরিপ্রেক্ষিতে ওয়ারেন্ট রয়েছে, যার ভিত্তিতে রেড নোটিশ জারির আবেদন করা হয়েছে।
ইন্টারপোলের সিদ্ধান্তের অপেক্ষায় সরকার
বর্তমানে ইন্টারপোলে আবেদনগুলো যাচাই-বাছাই পর্যায়ে রয়েছে। সংস্থাটি প্রতিটি মামলার নথিপত্র, অভিযোগের প্রকৃতি, রাজনৈতিক উদ্দেশ্য আছে কি না—এসব খতিয়ে দেখেই রেড নোটিশ জারি করে। এ সিদ্ধান্ত কতদিনে হবে, সে বিষয়ে নির্দিষ্ট সময়সূচি নেই, তবে প্রক্রিয়াটি অগ্রসরমান।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মন্তব্য
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক রাজনৈতিক বিশ্লেষক মনে করছেন, এ ধরনের পদক্ষেপ নজিরবিহীন। এটি রাজনৈতিক পালাবদলের পরিণতি এবং এতে আন্তর্জাতিক মহলে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি ও পররাষ্ট্রনীতির ওপর বড় প্রভাব পড়তে পারে।
রেড নোটিশ জারির আবেদন শুধু আইনি বা প্রশাসনিক পদক্ষেপ নয়, এটি বর্তমান ও অতীত ক্ষমতাকেন্দ্রের মধ্যে এক ধরনের সংঘর্ষের বহিঃপ্রকাশ হিসেবেও দেখা হচ্ছে।
বাংলাবার্তা/এমএইচ