
ছবি: সংগৃহীত
বাংলাদেশের নাগরিক পাসপোর্টে বহুল আলোচিত ‘Except Israel’ বা ‘ইসরাইল ব্যতীত বিশ্বের সব দেশের জন্য প্রযোজ্য’ বাক্যটি ফের যুক্ত করেছে অন্তর্বর্তী সরকার। দেশের অভ্যন্তরীণ এবং আন্তর্জাতিক পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে এই পদক্ষেপকে বাস্তবসম্মত বলে উল্লেখ করেছেন সাবেক কূটনীতিক ও রাষ্ট্রদূত এম হুমায়ুন কবির।
গত ১৩ এপ্রিল স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সুরক্ষা বিভাগ থেকে প্রকাশিত এক সরকারি প্রজ্ঞাপনে বিষয়টি জানানো হয়। পূর্ববর্তী সরকার এই বাক্যটি ২০২১ সালে পাসপোর্ট থেকে বাদ দিলেও তা নিয়ে দেশে বিতর্ক ও জনমতের ঢেউ ওঠে। এবার অন্তর্বর্তী সরকারের সিদ্ধান্তে ‘Except Israel’ বাক্যের পুনঃস্থাপন যেন সেই জনমতের প্রতিফলনই ঘটিয়েছে।
এই বিষয়ে শনিবার এফডিসিতে অনুষ্ঠিত ‘ছায়া সংসদ’-এ প্রধান অতিথির বক্তব্যে সাবেক রাষ্ট্রদূত হুমায়ুন কবির বলেন, “পাসপোর্টে ‘ইসরাইল ব্যতীত’ বাক্য পুনরায় সংযোজন বর্তমান সরকারের একটি সময়োপযোগী ও বাস্তবসম্মত পদক্ষেপ। এতে দেশের সাধারণ মানুষের আবেগ ও অবস্থান স্পষ্টভাবে প্রতিফলিত হয়েছে। একইসঙ্গে এটি আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশের অবস্থানকে সুস্পষ্ট করে তোলে।”
এই ছায়া সংসদটির আয়োজন করে ডিবেট ফর ডেমোক্রেসি। প্রতিযোগিতায় বিজিএমইএ ইউনিভার্সিটি অব ফ্যাশন অ্যান্ড টেকনোলজির বিতার্কিকদের হারিয়ে চ্যাম্পিয়ন হয় স্টেট ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশের বিতার্কিক দল। সমাপনী বক্তব্যে অংশগ্রহণকারী দলকে ট্রফি, ক্রেস্ট ও সনদপত্র দেওয়া হয়।
গাজা পরিস্থিতি প্রসঙ্গে হুমায়ুন কবির বলেন, “বর্তমানে ফিলিস্তিনের গাজা ভূখণ্ডে যা চলছে তা কোনো সংঘর্ষ নয়, বরং এটি একটি পরিকল্পিত জাতিগত নির্মূল অভিযান। নারী, শিশু, বয়োজ্যেষ্ঠ কেউই রেহাই পাচ্ছে না। এটি মানবাধিকার লঙ্ঘনের এক ভয়াবহ নজির।”
তিনি আরও বলেন, “আন্তর্জাতিক চাপ ও জনমত সত্ত্বেও ইসরাইল এ অভিযান চালিয়ে যাচ্ছে। মুসলিম বিশ্বের ঐক্য থাকলেও, শুধু মুসলিম দেশগুলো একা গাজার জন্য যথেষ্ট নয়। এ সংকট নিরসনে জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের ঐক্যবদ্ধ, কার্যকর ও সময়োপযোগী হস্তক্ষেপ প্রয়োজন।”
হুমায়ুন কবির এ সময় আরও বলেন, মুসলিম বিশ্বের হাতে এখন সেই তেলের অস্ত্রটিও নেই, যা এক সময় রাজনৈতিক কূটনীতির হাতিয়ার ছিল। “তেলের বাজার নিয়ন্ত্রণ এখন মুসলিম বিশ্বের হাতে নেই। বড় বড় উৎপাদক দেশ এখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া ও অন্যান্যরা। ফলে, কূটনৈতিক চাপ তৈরির সুযোগ অনেক কমে গেছে।”
এছাড়াও ভারতের সদ্য পাশ হওয়া ওয়াকফ সংশোধনী বিল নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে তিনি বলেন, “এটা অহেতুক সমস্যা তৈরি করবে এবং ভারতের সংখ্যালঘু মুসলমানদের অধিকার হরণ করতে পারে। এটি রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে প্রণীত বলে মনে হয়, যা একটি বিশেষ সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে বৈষম্যমূলক আচরণ প্রতিষ্ঠার ঝুঁকি সৃষ্টি করে।”
অনুষ্ঠানের সভাপতির বক্তব্যে ডিবেট ফর ডেমোক্রেসির চেয়ারম্যান হাসান আহমেদ চৌধুরী কিরণ বলেন, “গাজা এখন মৃত্যুপুরী। নারী, শিশু, সাংবাদিক, চিকিৎসক, মানবাধিকার কর্মী কেউই নিরাপদ নয়। ইসরাইলি বাহিনীর বর্বরতায় গাজার রাস্তায় রক্ত, হাসপাতালগুলোতে কান্না, ধ্বংসস্তূপের নিচে চাপা পড়া মানুষের জীবন-মৃত্যুর আর্তনাদ। ইতিহাসে এমন গণহত্যার নজির বিরল।”
তিনি আরও বলেন, “গাজাকে যেখানে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় প্রয়োজনীয় মানবিক সহায়তা পাঠানো বন্ধ করে দিয়েছে, সেখানে বাংলাদেশের জনগণ নিরন্তরভাবে ফিলিস্তিনের পাশে রয়েছে। বাংলাদেশে অনুষ্ঠিত ‘মার্চ ফর গাজা’ কর্মসূচি স্পষ্টভাবে প্রমাণ করেছে—এই লড়াই শুধু গাজার নয়, এ লড়াই আমাদেরও।”
ফিলিস্তিন নিয়ে দেশের জনগণের আবেগ ও অবস্থান যে অবিচল, সেই অবস্থানই ‘এক্সসেপ্ট ইসরাইল’ বাক্যের পুনঃপ্রতিষ্ঠার মাধ্যমে সরকারিকভাবে পুনরায় নির্ধারিত হলো বলে বিশ্লেষকদের অভিমত। এটি শুধুই রাজনৈতিক বার্তা নয়, বরং এটি বাংলাদেশের ঐতিহাসিক পররাষ্ট্রনীতির ধারাবাহিকতা বজায় রাখার একটি কূটনৈতিক প্রকাশও।
সবমিলিয়ে, এই সিদ্ধান্ত আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশকে তার আদর্শিক অবস্থানে আবারো দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত করলো এবং দেশবাসীর প্রত্যাশার প্রতি সম্মান জানালো।
বাংলাবার্তা/এমএইচ