
ছবি: সংগৃহীত
বাংলাদেশে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের পর পরই রাজধানী ঢাকা সহ দেশজুড়ে এক ভয়ংকর মামলা বাণিজ্য চক্র গড়ে উঠেছে, যা একাধিক গোষ্ঠী এবং আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সদস্যদের দ্বারা পরিচালিত হচ্ছে। এর মধ্যে বিশেষ করে গুলশান থানায় দায়ের করা একটি হত্যা মামলার ঘটনা আলোচিত। যেখানে বাদী নিজেই স্বীকার করেছেন, অধিকাংশ আসামিকে তিনি চেনেন না এবং মামলায় তাদের সম্পৃক্ততা সম্পর্কে কোন তথ্য নেই।
এজাহারভুক্ত তিনজন ভুক্তভোগী বাদীকে অনুরোধ করেন, তাদের নাম মামলা থেকে বাদ দেয়ার জন্য। তবে বাদী তাদের বিষয়টি সাত দিনের মধ্যে সমাধান করার কথা বলেন। কিন্তু, সাত দিন পর ভুক্তভোগীরা আবার যোগাযোগ করলে বাদী তাদের দাবি করেন যে, নাম বাদ দেওয়ার জন্য ৬ কোটি টাকা দিতে হবে। না হলে, মামলা থেকে নাম বাদ দেয়া হবে না।
এটি শুধুমাত্র একটি উদাহরণ, তবে বর্তমানে দেশের বিভিন্ন জায়গায় এমন ধরনের মামলাবাজ চক্রের ব্যাপক প্রসার ঘটেছে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে, এই ধরনের মামলা যেখানে আসামি এবং বাদী একে অপরকে চেনেন না, সেগুলি প্রহসনমূলক মামলা হিসেবে দাঁড়িয়েছে। বিশেষভাবে বলা যেতে পারে, এমন মামলাগুলোর সঙ্গে জড়িত কর্মকর্তারা দাবি করছে, তাদের থেকে লাখ লাখ টাকা আদায়ের জন্য নিরীহ মানুষকে জড়ানো হচ্ছে। মামলা বাণিজ্য এমন এক ভয়ংকর চক্র হিসেবে কাজ করছে যেখানে শুধু ব্যবসায়ী, ঠিকাদার এবং সরকারি কর্মকর্তাদেরই নয়, সাধারণ মানুষও এর শিকার হচ্ছেন।
অভিযোগ উঠেছে, পুলিশও এই চক্রের সঙ্গে জড়িত। এক বিশেষ মামলায়, এক ব্যক্তি একাধিক মিথ্যা মামলায় গ্রেপ্তার হন, অথচ তিনি জানেন না কী কারণে তাকে আটক করা হয়েছে। ওই মামলার বাদীও তাকে চেনেন না। এমন পরিস্থিতিতে, অনেক মামলাবাজ চক্রের সদস্যরা প্রমাণের অভাব থাকা সত্ত্বেও একের পর এক নিরীহ মানুষকে মামলায় ফাঁসাচ্ছে।
এ বিষয়ে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ (ডিএমপি) তাদের অফিস আদেশে নির্দেশ দিয়েছে যে, তদন্ত ছাড়া কোন আসামিকে গ্রেপ্তার করা যাবে না। কিন্তু এই নির্দেশনা সত্ত্বেও, মামলার প্রকৃত পরিস্থিতি অপরাধী তৈরির বদলে তদন্তের শুদ্ধতা প্রশ্নবিদ্ধ করছে।
তদন্তকারী কর্মকর্তারা আরও জানাচ্ছেন, রাজনৈতিক প্রতিহিংসা, চাঁদাবাজি এবং পূর্বত্রুটির কারণে এসব মামলায় নিরীহ ব্যক্তিদের জড়ানো হচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এমন মিথ্যা মামলা ও দুর্নীতির ফলে সমাজে স্থায়ী অরাজকতা ও নৈরাজ্য সৃষ্টি হবে এবং ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তি প্রতিশোধ নিতে পারে।
এই পরিস্থিতির তীব্র সমালোচনা করেছেন কা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্কের অধ্যাপক ড. মুহম্মদ ইমতিয়াজ আহমেদ। তিনি বলেন, "এ ধরনের মামলা বাণিজ্য আইনের প্রতি মানুষের আস্থাহীনতা তৈরি করছে, যা সমাজের মূল ভিত্তি ক্ষতিগ্রস্ত করছে। রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত মামলার ঘটনা দেশে অস্থিরতা সৃষ্টি করতে পারে।"
এই ব্যাপারে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক ড. তৌহিদুল হক বলেন, “এ ধরনের মামলায় নিরীহ মানুষদের জড়ানো আইনত অপরাধ, যা সমাজে এক ভয়াবহ প্রভাব ফেলতে পারে। মানুষের মধ্যে আস্থাহীনতা তৈরি হবে এবং একসময় এটি বৃহত্তর সমাজে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করবে।”
মানবাধিকার কর্মী শামসুদ্দিন হোসেন বলেন, "এ ধরনের মামলাগুলোর মাধ্যমে নিরীহ মানুষের জীবন ধ্বংস হচ্ছে। রাষ্ট্রের দায়িত্ব এই ভয়ংকর চক্রকে প্রতিরোধ করা, কিন্তু তা না হলে দেশব্যাপী আস্থাহীনতা সৃষ্টি হবে।"
বিশিষ্ট আইনজ্ঞ প্রফেসর গোলাম রাব্বানী বলেন, "এটি একটি গুরুতর আইনি সমস্যা, যেখানে বিচারপ্রক্রিয়া এবং আইনপ্রয়োগের শুদ্ধতা প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে। এসব মামলার ফলে মিথ্যা অভিযোগের শিকার হওয়া মানুষদের জন্য মানসিক চাপ এবং অস্থিতিশীলতা তৈরি হবে।"
এভাবে মামলার এই ভয়ংকর চক্র দেশের বিচার ব্যবস্থাকে সংকটের মধ্যে ফেলে দিতে পারে, যেখানে প্রকৃত অপরাধীদের বিচার পাওয়া কঠিন হয়ে পড়বে।
বাংলাবার্তা/এমএইচ