
ছবি: সংগৃহীত
সরকার দেশের অন্যতম পরিবেশগত রক্ষাকবচ হিসেবে বিবেচিত বিশ্বের সর্ববৃহৎ ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চল সুন্দরবনের সংরক্ষণের লক্ষ্যে গুরুত্বপূর্ণ ও কঠোর সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে। এখন থেকে সুন্দরবনের আশপাশের ১০ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে যে অঞ্চলটি ‘প্রতিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকা’ (Ecologically Critical Area বা ECA) হিসেবে চিহ্নিত, সেখানে আর কোনো নতুন শিল্পপ্রতিষ্ঠান বা উন্নয়ন প্রকল্প স্থাপন করা যাবে না। পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয় এ সিদ্ধান্তের বাস্তবায়নে দ্রুত একটি প্রজ্ঞাপন জারি করতে যাচ্ছে।
এই সিদ্ধান্তটি গৃহীত হয়েছে সোমবার (২১ এপ্রিল) রাজধানীর সচিবালয়ে অনুষ্ঠিত পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয় এবং পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের যৌথ উদ্যোগে আয়োজিত জাতীয় পরিবেশ ও জলবায়ু পরিবর্তন কমিটির নির্বাহী কমিটির ১৬তম সভায়। সভায় সভাপতিত্ব করেন পরিবেশবাদী ও মানবাধিকারকর্মী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান, যিনি মন্ত্রণালয়টির উপদেষ্টা হিসেবেও দায়িত্ব পালন করছেন। পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয় সভা-পরবর্তী এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে বিস্তারিত তথ্য জানায়।
২০১৭ ও ২০২১ সালের নীতিগত সিদ্ধান্ত বাতিল, আরও কঠোর নজরদারির ঘোষণা
সভায় ২০১৭ সালের জাতীয় পরিবেশ কমিটি ও ২০২১ সালের নির্বাহী কমিটির আগের সিদ্ধান্তগুলো সংশোধন করে সুন্দরবনের আশেপাশে শিল্পায়নের ব্যাপারে আরও কঠোর ও পরিবেশবান্ধব অবস্থান নেওয়া হয়। পূর্ববর্তী সিদ্ধান্তগুলোতে শিল্পপ্রতিষ্ঠান স্থাপনের কিছু ব্যতিক্রম রাখা হয়েছিল, যা নতুন সিদ্ধান্তে পুরোপুরি নিষিদ্ধ করা হয়েছে।
যেসব শিল্পপ্রতিষ্ঠান ইতিমধ্যে ইসিএ অঞ্চলের মধ্যে স্থাপিত হয়েছে, সেগুলোর ব্যাপারে এখনই কোনো চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়নি। আদালতের নির্দেশনা অনুসারে, নিরপেক্ষ বিশেষজ্ঞদের দ্বারা এসব প্রতিষ্ঠানের পরিবেশগত প্রভাব নিরূপণ করা হবে। পরে সেই মূল্যায়নের ভিত্তিতেই পরবর্তী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
জলবায়ু ট্রাস্ট বিধিমালায় পরিবর্তন, শব্দদূষণ নিয়ন্ত্রণে নতুন কর্মপরিকল্পনা
সভায় জলবায়ু পরিবর্তন ট্রাস্ট বিধিমালার সংস্কারের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছে। এই সংস্কারের ফলে সরকারি-বেসরকারি সংস্থা এবং এনজিওগুলো যৌথভাবে প্রকল্প প্রস্তাব দিতে পারবে। এতে করে বাস্তবভিত্তিক এবং বহুমাত্রিক জলবায়ু প্রকল্প বাস্তবায়নের সুযোগ বাড়বে।
শব্দদূষণ নিয়ন্ত্রণে একটি সমন্বিত কর্মপরিকল্পনা তৈরির উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, যেখানে দেশের সকল মন্ত্রণালয়কে নিজ নিজ দৃষ্টিকোণ থেকে মতামত দিতে আহ্বান জানানো হবে। শব্দদূষণ বাংলাদেশের অন্যতম পরিবেশগত হুমকি হিসেবে চিহ্নিত, বিশেষ করে নগরায়নের প্রভাবে শহরাঞ্চলে এর মাত্রা উদ্বেগজনক পর্যায়ে পৌঁছেছে।
পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের বাজেটে বাড়তি বরাদ্দ, বন কর্মীদের ঝুঁকিভাতা বাড়বে
সভায় পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের এনফোর্সমেন্ট কার্যক্রম জোরদারে অতিরিক্ত বাজেট বরাদ্দের প্রস্তাবও পেশ করা হয়েছে। একই সঙ্গে বন অধিদপ্তরের মাঠ পর্যায়ের কর্মীদের ঝুঁকিভাতা চালু ও বাড়ানোরও সুপারিশ করা হয়েছে। সুন্দরবনের মতো ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় দায়িত্ব পালনকারী বনরক্ষীদের নিরাপত্তা এবং প্রণোদনা নিশ্চিত করা সরকারের অগ্রাধিকার বলেও সভায় জানানো হয়।
ভবন নির্মাণে পরিবেশবান্ধব উপকরণ ব্যবহারে বাধ্যবাধকতা
সভায় আরও সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে যে, ২০২৫ সালের মধ্যে সরকারি ও বেসরকারি ভবন নির্মাণে কমপক্ষে ৩০ শতাংশ ব্লক ব্যবহার বাধ্যতামূলক করা হবে। এই নীতিমালার বাস্তবায়ন তদারক করতে মে মাসে সচিব পর্যায়ে একটি সমন্বয় সভা অনুষ্ঠিত হবে। দেশীয় শিল্পে তৈরি ব্লক নির্মাণ সামগ্রী পরিবেশবান্ধব, টেকসই এবং দীর্ঘমেয়াদে প্রাকৃতিক সম্পদ সংরক্ষণে সহায়ক বলেও সভায় বলা হয়।
উপস্থিতি ও পরিবেশনা
সভায় উপস্থিত ছিলেন দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ফারুক ই আজম (বীরপ্রতীক), কৃষি ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী। এছাড়া সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের সিনিয়র সচিব মো. এহছানুল হক, পরিবেশ সচিব ড. ফারহিনা আহমেদ, বিদ্যুৎ বিভাগের সচিব ফারজানা মমতাজ, বাণিজ্য সচিব মাহবুবুর রহমান, স্থানীয় সরকার সচিব মো. রেজাউল মাকছুদ জাহেদী, গৃহায়ণ ও গণপূর্ত সচিব মো. নজরুল ইসলামসহ বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও দপ্তরের গুরুত্বপূর্ণ প্রতিনিধিরা।
সভায় উপস্থাপনা পরিচালনা করেন পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (পরিবেশ) ও নির্বাহী কমিটির সদস্য সচিব ফাহমিদা খানম। তিনি পাওয়ার পয়েন্টের মাধ্যমে আগের সভার সিদ্ধান্তগুলোর বাস্তবায়ন অগ্রগতি এবং নতুন প্রস্তাবিত সিদ্ধান্তসমূহ তুলে ধরেন।
এই বৈঠক এবং গৃহীত সিদ্ধান্তগুলো দেশের পরিবেশ সুরক্ষা, বিশেষ করে বিশ্ব ঐতিহ্য সুন্দরবনের সংরক্ষণে একটি নতুন দিক নির্দেশ করছে। পরিবেশবান্ধব উন্নয়ন এবং জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাত মোকাবিলায় সরকারের এ ধরনের পদক্ষেপ ভবিষ্যতের জন্য এক ইতিবাচক বার্তা বহন করে।
বাংলাবার্তা/এমএইচ