
ছবি: সংগৃহীত
রাষ্ট্রীয়ভাবে শ্রমিক আন্দোলনে নিহতদের ‘শহীদ’ হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার সুপারিশসহ বহুমুখী সংস্কার প্রস্তাব পেশ করেছে শ্রমবিষয়ক সংস্কার কমিশন। আজ সোমবার (২১ এপ্রিল) দুপুর ১২টায় রাজধানীর রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের হাতে এই প্রতিবেদন আনুষ্ঠানিকভাবে তুলে দেন কমিশনের সদস্যরা।
কমিশনের প্রতিবেদনে ২৫টি মৌলিক সুপারিশকে বিশেষভাবে গুরুত্ব দিয়ে উপস্থাপন করা হয়। এসব সুপারিশের মূল লক্ষ্য দেশের শ্রম পরিবেশকে মানবিক, সুরক্ষিত ও ন্যায্য ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত করা।
শহীদ স্বীকৃতি ও রাষ্ট্রীয় দায়বদ্ধতা
প্রতিবেদনের অন্যতম তাৎপর্যপূর্ণ প্রস্তাব হলো—১৯৭১-পরবর্তী সময়সহ চব্বিশের গণঅভ্যুত্থান ও শ্রমিক আন্দোলনে নিহত সব শ্রমিককে রাষ্ট্রীয়ভাবে 'শহীদ' স্বীকৃতি প্রদান। কমিশন মনে করে, শ্রমিকদের আত্মত্যাগের প্রতি সম্মান দেখানো ও ইতিহাসের প্রতি দায়বদ্ধতা পালনে এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ।
শুধু শহীদ স্বীকৃতির সুপারিশই নয়, কর্মক্ষেত্রে দুর্ঘটনা বা অবহেলাজনিত মৃত্যু ও আহতদের যথাযথ ক্ষতিপূরণ এবং পুনর্বাসন নিশ্চিতে একটি শক্তিশালী নীতিমালা প্রণয়নের প্রস্তাবও এসেছে কমিশনের পক্ষ থেকে।
রানা প্লাজা, তাজরিন ও হাসেম ফুড ট্র্যাজেডির বিচার
কমিশনের প্রতিবেদনে বেশ কয়েকটি বহুল আলোচিত শিল্প দুর্ঘটনার বিষয়েও আলোকপাত করা হয়। রানা প্লাজা ধস, তাজরিন গার্মেন্টসের অগ্নিকাণ্ড এবং হাসেম ফুড কারখানার আগুনে প্রাণহানির ঘটনার দায়ীদের এখনও বিচারের আওতায় না আনায় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছে। এ বিষয়ে দ্রুত বিচার ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির সুপারিশ করা হয়।
মানবিক কর্মপরিবেশ ও শ্রদ্ধাবোধের সংস্কৃতি
প্রতিবেদনের একটি ব্যতিক্রমী সুপারিশ হলো—কর্মক্ষেত্রে শ্রেণিগত ভেদাভেদের প্রতিফলন হিসেবে 'তুই-তুমি' সম্বোধনের অবসান। কমিশন বলছে, সব কর্মী যেন সম্মানের সঙ্গে ‘আপনি’ সম্বোধনে পরিচিত হন, এটি আধুনিক ও ন্যায্য কর্মপরিবেশ গড়ার পূর্বশর্ত।
প্রধান উপদেষ্টার ডেপুটি প্রেস সচিব আবুল কালাম আজাদ এ বিষয়ে তার অফিসিয়াল ফেসবুক পোস্টে লেখেন, “শ্রম সংস্কার কমিশনের অনেক সুপারিশের মধ্যে আমার সবচেয়ে বেশি ভালো লেগেছে কর্মপরিবেশে তুই-তুমি সংস্কৃতি বন্ধের প্রস্তাবটি। এটি আমাদের সংস্কৃতি ও সম্মানবোধে এক বড় পরিবর্তনের বার্তা।”
সব শ্রমিকের জন্য আইনি সুরক্ষা
কমিশনের প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, দেশের প্রত্যেক শ্রমিকের আইনি স্বীকৃতি ও সুরক্ষা নিশ্চিত করতে হবে। অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতেও শ্রম আইন প্রয়োগ করতে হবে, যাতে কোনো কর্মী বৈষম্যের শিকার না হন।
কমিশন উল্লেখ করেছে যে, কেবল নীতিগত অঙ্গীকার নয়, এসব সুপারিশ বাস্তবায়নের জন্য একটি স্বতন্ত্র ও শক্তিশালী ‘শ্রম সংস্কার বাস্তবায়ন সেল’ গঠন করা প্রয়োজন।
ভবিষ্যতের পথনকশা
শ্রমিক অধিকার, কর্মপরিবেশ, ন্যায্য মজুরি এবং সামাজিক নিরাপত্তা নিয়ে কমিশনের এই প্রস্তাবনাগুলো অন্তর্বর্তী সরকারের ভবিষ্যৎ কর্মকৌশলের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ ভিত্তি তৈরি করবে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।
তবে এ প্রতিবেদন কতটা বাস্তবায়ন হবে তা নির্ভর করছে সরকারের রাজনৈতিক সদিচ্ছা, শিল্পপতিদের সহযোগিতা এবং সমাজের বৃহত্তর অংশের নৈতিক অবস্থানের ওপর।
এটি শুধু একটি শ্রম কমিশনের রিপোর্ট নয়—এটি শ্রমিকদের প্রতি জাতির দায়মোচনের একটি সুযোগ। শহীদ স্বীকৃতি, ন্যায়বিচার এবং সম্মানভিত্তিক শ্রম সংস্কৃতি গঠনের পথে এটি হতে পারে একটি ঐতিহাসিক মাইলফলক।
বাংলাবার্তা/এমএইচ