
ছবি: সংগৃহীত
ভারতের সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিএসএফের গুলিতে গত পাঁচ বছরে বাংলাদেশের সীমান্ত অঞ্চলে অন্তত ১৫১ জন নাগরিক প্রাণ হারিয়েছেন। মানবাধিকার সংগঠন ‘আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক)’-এর সর্বশেষ প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে। সীমান্ত হত্যা ও নির্যাতনের এই দীর্ঘসূত্রতা কেবল মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিষয় নয়, বরং প্রতিবেশী দুই দেশের সম্পর্কের ওপরও ফেলছে গভীর ছায়া।
প্রতিবেদন অনুযায়ী, উত্তরাঞ্চলের রংপুর বিভাগে এসব মৃত্যুর হার সবচেয়ে বেশি। সেখানে গত পাঁচ বছরে বিএসএফের গুলিতে নিহত হয়েছেন ৬১ জন বাংলাদেশি। এর মধ্যে কেবল লালমনিরহাট জেলাতেই প্রাণ হারিয়েছেন ১৯ জন।
সিংগীমারীর ঘটনা ঘিরে উত্তেজনা
লালমনিরহাটের পাটগ্রামের সিংগীমারী সীমান্তে সর্বশেষ ঘটে আরেক মর্মান্তিক ঘটনা। গত ১৭ এপ্রিল সীমান্তে গরুর ঘাস কাটতে গিয়েছিলেন স্থানীয় যুবক হাসিবুল। অভিযোগ উঠেছে, সীমান্ত পেরিয়ে বাংলাদেশ অংশে ঢুকে বিএসএফ সদস্যরা তাকে ধরে নিয়ে যান এবং পরে নির্যাতন চালিয়ে হত্যা করেন। হাসিবুলের ক্ষতবিক্ষত দেহের বিবরণ দিয়ে তার মা বলেন, “ওদের রাইফেলের মাথা দিয়ে বুক খুঁচিয়ে ছেলেকে ক্ষতবিক্ষত করেছে। তারপর আটা বস্তার মতো গাড়িতে তুলে নিয়ে চলে গেছে।”
এই ঘটনায় এলাকায় উত্তেজনা তৈরি হলেও সীমান্ত কর্তৃপক্ষের পক্ষ থেকে এখনও পর্যন্ত কোনো কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি বলে দাবি করেছে স্থানীয়রা।
ফেলানী হত্যার ১৩ বছর পরেও বিচারহীনতা
২০১১ সালের ৭ জানুয়ারি কুড়িগ্রামের ফুলবাড়ী সীমান্তে কাঁটাতারে ঝুলন্ত অবস্থায় পাওয়া যায় ১৫ বছরের কিশোরী ফেলানী খাতুনের মরদেহ। সেই সময় এই ঘটনা আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমেও ব্যাপক আলোড়ন তোলে। তবে ১৩ বছর পার হলেও ফেলানীর পরিবার আজও পায়নি কাঙ্ক্ষিত ন্যায়বিচার।
ফেলানীর হত্যাকারী বিএসএফ সদস্যকে ভারতীয় আদালত দুই দফা বেকসুর খালাস দিলে, পরিবার ও মানবাধিকার সংগঠনগুলো হতাশা প্রকাশ করে। এই ঘটনার পর সীমান্ত হত্যা নিয়ে সচেতনতা বাড়লেও বাস্তবে খুব একটা পরিবর্তন ঘটেনি।
সীমান্ত ব্যবস্থাপনার ঘাটতি ও বিশ্লেষকদের মত
আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষক ত্বহা হুসাইন বলেন, “সীমান্ত ব্যবস্থাপনায় দুই দেশের মধ্যে সমন্বয়ের ঘাটতি রয়েছে। বিদ্যমান দ্বিপক্ষীয় চুক্তিগুলোতে স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে—সীমান্ত অতিক্রমকারীকে আইনের আওতায় আনা যাবে, কিন্তু তাকে গুলি করে হত্যা করা যাবে না।”
তিনি আরও বলেন, “বিএসএফ বারবার চুক্তির শর্ত ভঙ্গ করছে। এটি কেবল মানবিক সংকট নয়, রাজনৈতিক দ্বন্দ্বও।”
বিশ্লেষকদের মতে, বিএসএফ বরাবরই অজুহাত দেয় ‘অবৈধ অনুপ্রবেশ’ ও ‘পাচার রোধ’-এর, অথচ তাদের আচরণ একটি সুপ্রতিবেশী রাষ্ট্রের নীতিমালার সঙ্গে সাংঘর্ষিক।
বিজিবির অবস্থান
বাংলাদেশ বর্ডার গার্ড (বিজিবি)-এর পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, তারা সীমান্ত নিরাপত্তা জোরদারে কাজ করছে। ১৫ বিজিবির অধিনায়ক লে. কর্নেল মেহেদী ইমাম বলেন, “সীমান্তের জিরো লাইনের ১৫০ গজের মধ্যে যাতে কেউ প্রবেশ করতে না পারে, এবং আমাদের পক্ষ থেকেও কেউ তা অতিক্রম না করে, সেজন্য নিয়মিত টহল পরিচালিত হচ্ছে।”
তবে বাস্তবে সীমান্তে বহু জায়গায় চিহ্নিত জিরো লাইনের সঠিক সীমারেখা না থাকায়, সাধারণ কৃষক কিংবা শ্রমজীবী মানুষ অনিচ্ছাকৃতভাবে সীমান্ত রেখা অতিক্রম করেন। সেই সুযোগে বহু সময়েই বিএসএফের গুলিতে প্রাণ হারান তারা।
মানবাধিকারের প্রশ্নে আন্তর্জাতিক পদক্ষেপ জরুরি
আসক-এর নির্বাহী পরিচালক নূর খান লিটন বলেন, “আমরা প্রতিটি হত্যার পর প্রতিবাদ করি, প্রতিবেদন তৈরি করি। কিন্তু ভারতীয় কর্তৃপক্ষের পক্ষ থেকে তেমন কোনো জবাবদিহিতা নেই। দুই দেশের সরকারকেই এবার বিষয়টি আন্তর্জাতিক অঙ্গনে তোলার কথা ভাবতে হবে।”
তিনি আরও বলেন, “সীমান্তে গুলি নয়, দরকার সহযোগিতা। প্রতিটি মানুষের জীবন গুরুত্বপূর্ণ—সেটি ভারতীয় হোক বা বাংলাদেশি। সীমান্তে জীবন হরণের নীতিকে কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য করা যায় না।”
ভবিষ্যৎ করণীয়
বিশ্লেষকরা বলছেন, এখন সময় হয়েছে রাজনৈতিকভাবে শক্ত অবস্থান নেওয়ার। সীমান্ত হত্যার বিরুদ্ধে কূটনৈতিক তৎপরতা জোরদার না করলে, এ পরিস্থিতি চলতেই থাকবে। বিশেষ করে ফেলানীর মতো প্রতিটি ঘটনার আন্তর্জাতিক তদন্ত দাবি করার পাশাপাশি, ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তে মানবাধিকার রক্ষায় একটি যৌথ কমিটি গঠন জরুরি হয়ে উঠেছে।
মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করলে, সীমান্তে প্রতিটি মৃত্যুই রাষ্ট্রের ব্যর্থতা—আর প্রতিবেশী রাষ্ট্রের ওপর দায়িত্বহীনতা। এখন প্রয়োজন সীমান্তকে মৃত্যু-নির্ভর এলাকা থেকে মানুষ-বান্ধব নিরাপত্তা বলয়ে রূপান্তর করা।
বাংলাবার্তা/এমএইচ