
ছবি: সংগৃহীত
সাংবাদিকদের পেশাগত নিরাপত্তা, মর্যাদা এবং সামাজিক সুরক্ষা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে বাংলাদেশে প্রথমবারের মতো ব্যাপক ও সুদূরপ্রসারী প্রস্তাবনা দিয়েছে শ্রম সংস্কার কমিশন। এই কমিশন সম্প্রতি সাংবাদিকদের জন্য ঝুঁকি ভাতা, স্বাস্থ্য ও জীবন বিমা এবং পেনশন চালুর সুপারিশসহ একটি পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন প্রধান উপদেষ্টা ও নোবেল বিজয়ী অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের হাতে হস্তান্তর করেছে।
গতকাল সোমবার রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় আনুষ্ঠানিকভাবে এই প্রতিবেদন হস্তান্তর করা হয়। শ্রম সংস্কার কমিশন ২০২৪ সালের ১৭ নভেম্বর গঠিত হয় অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের অধীনে, যেখানে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিজ (বিআইএলএস)-এর নির্বাহী পরিচালক সৈয়দ সুলতান উদ্দিন আহমেদকে প্রধান করে মোট ১০ সদস্য অন্তর্ভুক্ত করা হয়।
কমিশনের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, সাংবাদিকতা একটি ঝুঁকিপূর্ণ পেশা হওয়া সত্ত্বেও বাংলাদেশে এই পেশায় নিয়োজিত ব্যক্তিরা এখনও সুনির্দিষ্ট সামাজিক সুরক্ষা কাঠামোর আওতায় আসেননি। বর্তমান শ্রম আইনে তাদের সুরক্ষা সীমিত এবং অনেকক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়। এ কারণে কমিশন সাংবাদিক ও গণমাধ্যমকর্মীদের জন্য ‘দ্য নিউজপেপার এমপ্লয়িজ (কন্ডিশন অব সার্ভিস) অ্যাক্ট, ১৯৭৪’-এর আদলে একটি পৃথক আইন প্রণয়নের সুপারিশ করেছে। বিকল্পভাবে, বিদ্যমান শ্রম আইনে একটি পৃথক অধ্যায় যুক্ত করে তাদের অন্তর্ভুক্ত করার কথাও বলা হয়েছে।
সাংবাদিক পরিচয়ের প্রসারণ ও অন্তর্ভুক্তিমূলক ধারা যুক্ত করার আহ্বান
প্রতিবেদনে স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে, শুধুমাত্র ‘সংবাদপত্র শ্রমিক’ না বলে ‘গণমাধ্যম শ্রমিক/কর্মী’ শব্দবন্ধ ব্যবহার করে আইনি সংজ্ঞা বিস্তৃত করতে হবে, যাতে রেডিও, টেলিভিশন, অনলাইন এবং ব্রডকাস্ট মিডিয়ার সাংবাদিক ও কর্মীরাও এর আওতায় আসেন। রিপোর্টার থেকে শুরু করে প্রযোজক, ভিডিও সম্পাদক, ক্যামেরাম্যান, গ্রাফিক্স ডিজাইনার, নিউজরুম সহকারী—সবার সুরক্ষা নিশ্চিত করতে হবে।
কমিশন সুপারিশ করেছে, সব সাংবাদিক ও গণমাধ্যমকর্মীদের জন্য বাধ্যতামূলকভাবে নিয়োগপত্র প্রদান নিশ্চিত করতে হবে, যাতে তাদের কর্মপরিচয়, কর্মস্থলের অধিকার ও আইনি সুরক্ষা স্বীকৃত হয়। এ ছাড়া তাদের জন্য নির্ধারিত কর্মঘণ্টা, সাপ্তাহিক ও বার্ষিক ছুটি, মাতৃত্বকালীন ছুটির বিধান এবং অতিরিক্ত কাজের জন্য উপযুক্ত ভাতা নিশ্চিত করার কথাও বলা হয়েছে।
বেতন, পেনশন ও কল্যাণ তহবিল বিষয়ক সুপারিশ
প্রতিটি সংবাদমাধ্যমে সাংবাদিকদের নিয়মিত বেতন পরিশোধ নিশ্চিত করতে কমিশন বলেছে, মালিকপক্ষকে প্রতিমাসে বেতন প্রদান সংক্রান্ত ডকুমেন্ট কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরে পাঠাতে হবে, যাতে শৃঙ্খলা ও জবাবদিহি প্রতিষ্ঠিত হয়।
এছাড়া ঝুঁকিপূর্ণ কভারেজ, বিশেষ করে রাজনৈতিক সহিংসতা, দুর্যোগ কিংবা অপরাধবিষয়ক রিপোর্টিংয়ের সময় সাংবাদিকদের জীবনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ‘ঝুঁকি ভাতা’ চালু করা, কর্মস্থলে দুর্ঘটনা বা রোগজনিত কারণে ক্ষতিগ্রস্ত সাংবাদিকদের জন্য বিমা সুবিধা এবং অবসরের পর একটি নির্দিষ্ট পেনশন কাঠামো চালুর সুপারিশ করা হয়েছে।
কমিশন আরো উল্লেখ করেছে, সংবাদপত্র কিংবা টেলিভিশনের পর্দার পেছনে কাজ করা সকল ব্যক্তিকে “চিত্র সাংবাদিক” হিসেবে স্বীকৃতি দিতে হবে, যাতে তাদের অবদান ও পরিচয় সরকারি ও সামাজিকভাবে স্বীকৃত হয়।
সাংবাদিক কল্যাণ ট্রাস্টে কাঠামোগত সংস্কারের আহ্বান
বর্তমান সাংবাদিক কল্যাণ ট্রাস্ট ব্যবস্থাটি কার্যকর নয় এবং এটি অধিকাংশ সময় রাজনৈতিক ও আমলাতান্ত্রিক সীমাবদ্ধতায় পড়ে যায় বলে কমিশন মনে করে। তাই এ ট্রাস্টকে কার্যকর, স্বচ্ছ এবং সাংবাদিকদের প্রকৃত কল্যাণে নিয়োজিত করার জন্য কাঠামোগত সংস্কার, স্বাধীন পরিচালনা পর্ষদ এবং সাংবাদিকদের সরাসরি অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার সুপারিশ করা হয়েছে।
এই সুপারিশগুলো বাস্তবায়িত হলে সাংবাদিকদের কর্মপরিবেশ এবং সামাজিক সুরক্ষা অনেকাংশে উন্নত হবে বলে সংশ্লিষ্ট মহল মনে করছে। গণমাধ্যম কর্মীদের অধিকার ও মর্যাদা রক্ষায় এটিকে একটি মাইলফলক উদ্যোগ হিসেবে দেখছেন পেশাজীবীরা। এখন দেখা যাক, এই সুপারিশগুলোর বাস্তবায়ন কীভাবে এবং কবে শুরু হয়, এবং সরকার এতে কী পদক্ষেপ নেয়।
বাংলাবার্তা/এমএইচ