
ছবি: সংগৃহীত
অস্ট্রেলিয়ার শীর্ষস্থানীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান অস্ট্রেলিয়ান ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি (এএনইউ) বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ নেত্রী শেখ হাসিনাকে প্রদানকৃত সম্মানসূচক ডক্টর অব লজ (Doctor of Laws) ডিগ্রি বাতিলের প্রক্রিয়া শুরু করেছে। ১৯৯৯ সালে প্রাপ্ত এই সম্মাননাটি বর্তমানে সাময়িকভাবে স্থগিত রাখা হয়েছে এবং তা বাতিলের আনুষ্ঠানিক রিভিউ প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে বলে নিশ্চিত করেছে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ।
এএনইউ’র মুখপাত্র অস্ট্রেলিয়ান অ্যাসোসিয়েটেড প্রেস (AAP) ও গণমাধ্যম দ্য ক্যানবেরা টাইমস-কে জানিয়েছেন, “এই বিশ্ববিদ্যালয়ের সাম্প্রতিক ইতিহাসে কাউকে একবার সম্মানসূচক ডিগ্রি দেওয়ার পর তা প্রত্যাহার করে নেওয়ার কোনো নজির নেই।” তবে হাসিনার বিরুদ্ধে গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ, রাজনৈতিক সহিংসতায় জড়িত থাকার তথ্য এবং আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থার তদন্তের আলোকে এই সিদ্ধান্ত প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। মুখপাত্র জানান, পর্যালোচনা শেষে উপাচার্য ও সিনেটের অনুমোদনক্রমে ডিগ্রি বাতিল চূড়ান্ত হবে।
মানবাধিকার লঙ্ঘন, দমন-পীড়ন ও হত্যার অভিযোগে ক্ষুব্ধ বিশ্ব
শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে সর্বশেষ অভিযোগগুলো এসেছে হিউম্যান রাইটস ওয়াচ (HRW)-এর রিপোর্ট থেকে, যেখানে উল্লেখ করা হয়েছে—২০২4 সালের জুলাই-আগস্টে ঢাকায় ছাত্র ও জনতার শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভে সরাসরি গুলি চালানোর নির্দেশ দেন তিনি নিজে। ওই সময়ে সরকারবিরোধী আন্দোলন দমনে রাষ্ট্রযন্ত্র ব্যবহার করে অসংখ্য শিক্ষার্থী ও নাগরিককে হত্যা করা হয়। এই ঘটনাগুলো দেশে-বিদেশে ব্যাপক সমালোচনার জন্ম দেয় এবং আন্তর্জাতিক মহলে শেখ হাসিনার ভাবমূর্তি মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
এই ঘটনার পটভূমিতে ঢাকার একটি আদালত হাসিনার বিরুদ্ধে গণহত্যা ও ক্ষমতার অপব্যবহারের অভিযোগে ফৌজদারি মামলা গ্রহণ করে এবং তার বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করে। এরপর থেকেই তিনি বাংলাদেশ ছেড়ে ভারতের কলকাতায় আশ্রয় নিয়েছেন। গত বছরের ৫ আগস্ট তিনি বাংলাদেশ ত্যাগ করেন এবং তখন থেকেই ভারতে অবস্থান করছেন।
আন্তর্জাতিকভাবে চাপ ও পরিণতির মুখে শেখ হাসিনা
বাংলাদেশ সরকার শেখ হাসিনাকে দেশে ফিরিয়ে আনার লক্ষ্যে ভারত সরকারের কাছে বন্দী প্রত্যর্পণ চুক্তির আওতায় আনুষ্ঠানিক আবেদন করেছে বলে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে। যদিও ভারত এখনো এই বিষয়ে কোনো আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়া জানায়নি, তবে বাংলাদেশে একটি আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনালে বিচার প্রক্রিয়া শুরুর আভাস দিয়েছেন সরকারি আইনজীবীরা।
অস্ট্রেলিয়ার মত গণতান্ত্রিক ও মানবাধিকার মূল্যবোধসম্পন্ন দেশগুলো এই ঘটনার প্রতি উদ্বেগ প্রকাশ করছে। বিশেষ করে এএনইউ’র মত মর্যাদাসম্পন্ন বিশ্ববিদ্যালয় যখন কাউকে সম্মানসূচক ডিগ্রি দেয়, তখন সেটি শুধু একাডেমিক কৃতিত্ব নয়, বরং মানবিক ও নৈতিক মূল্যবোধের স্বীকৃতি হিসেবেও বিবেচিত হয়। তাই শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে এতবড় মানবাধিকার লঙ্ঘনের প্রমাণ ওঠে আসায় বিশ্ববিদ্যালয়ের অভ্যন্তরীণ মূল্যায়ন কমিটি তার ডিগ্রি বাতিলের যৌক্তিকতা পর্যালোচনা করছে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের এক সিনিয়র অ্যাকাডেমিক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, “যদি কাউকে ডিগ্রি দিয়ে পরে জানা যায় তিনি মানবাধিকার লঙ্ঘনের সঙ্গে যুক্ত, তাহলে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কাছে সেটা এক নৈতিক সংকট তৈরি করে। শেখ হাসিনার ক্ষেত্রে আমরা সেটাই অনুভব করছি।”
বাংলাদেশে প্রতিক্রিয়া
এই খবরে বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনেও মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে। আওয়ামী লীগের ঘনিষ্ঠ মহল এটিকে রাজনৈতিক ষড়যন্ত্র হিসেবে দাবি করলেও অধিকাংশ বিরোধী দল, বিশেষ করে ছাত্র আন্দোলনের নেতারা একে ‘ন্যায়বিচারের একটি ছোট পদক্ষেপ’ বলে অভিহিত করেছেন। তাঁদের ভাষ্য, “একজন স্বৈরাচারী শাসকের আসল চেহারা আজ আন্তর্জাতিকভাবে উন্মোচিত হচ্ছে।”
বিশিষ্ট মানবাধিকার কর্মী ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক ড. রেহানা মজুমদার বলেন, “১৯৯৯ সালে এএনইউ যে ডিগ্রিটি দিয়েছিল, তা ছিল একটি রাজনৈতিক কৌশল। কিন্তু আজ বিশ্বের সচেতনতা ও তথ্যপ্রযুক্তির বিস্তারের ফলে আর কাউকে সত্য আড়াল করে রাখা সম্ভব নয়। ডিগ্রি বাতিলের সিদ্ধান্ত ইতিহাসে এক নতুন দৃষ্টান্ত তৈরি করবে।”
অস্ট্রেলিয়ান বিশ্ববিদ্যালয়ে নজিরবিহীন ঘটনা
এএনইউ, যা আন্তর্জাতিকভাবে গবেষণা, নীতিনির্ধারণ ও মানবাধিকার চর্চার ক্ষেত্রে বিশ্বখ্যাত, তাদের একাডেমিক সম্মান বাতিলের সিদ্ধান্ত এই প্রথম নিতে যাচ্ছে। শিক্ষাবিদরা বলছেন, এটি শুধু শেখ হাসিনার জন্য নয়, বরং ভবিষ্যতে যেকোনো নেতার জন্য একটি সতর্কবার্তা—ক্ষমতা থাকলেই সম্মান অর্জন করা যায় না, বরং সেটির জন্য প্রয়োজন নৈতিকতা ও মানবিক মূল্যবোধ।
ডিগ্রিটি বাতিল হলে, শেখ হাসিনা হবেন সেই বিরল রাজনীতিকদের একজন, যাঁর সম্মানসূচক ডিগ্রি মানবাধিকার লঙ্ঘনের কারণে ফিরিয়ে নেওয়া হয়েছে। এটি কেবল তাঁর রাজনৈতিক জীবনের এক কালো অধ্যায় নয়, বরং দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতিতে কর্তৃত্ববাদী শাসনের বিরুদ্ধে একটি কঠিন বার্তা হিসেবেও বিবেচিত হবে।
বাংলাবার্তা/এমএইচ