
ছবি: সংগৃহীত
দেশের আইন-শৃঙ্খলা ব্যবস্থাকে যুগোপযোগী ও জনগণের আস্থাভাজন করতে পুলিশ প্রশাসনের পুরোনো ও বিতর্কিত প্রথাগুলোর বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান ঘোষণা করেছেন স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী। যশোরে সরকারি কর্মকর্তাদের সঙ্গে এক গুরুত্বপূর্ণ মতবিনিময় সভায় তিনি স্পষ্টভাবে জানান, কোনো পুলিশ সদস্য আর সিভিল ড্রেসে (সাধারণ পোশাকে) আসামি ধরতে পারবে না। এই প্রথা বন্ধে এখনই কার্যকর ব্যবস্থা নিতে হবে বলে তিনি সতর্ক করেন।
মঙ্গলবার (২২ এপ্রিল) বিকেল সাড়ে ৩টায় যশোর জেলা প্রশাসকের সম্মেলনকক্ষে অনুষ্ঠিত এক মতবিনিময় সভায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা এসব কথা বলেন। সভায় উপস্থিত ছিলেন প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) আব্দুল হাফিজ, যশোর সেনানিবাসের জিওসি মেজর জেনারেল জে এম ইমদাদুল ইসলাম, খুলনা বিভাগের ডিআইজি মো. রেজাউল হক, জেলা প্রশাসক মো. আজাহারুল ইসলাম, পুলিশ সুপার রওনক জাহানসহ আইন-প্রশাসনের শীর্ষ কর্মকর্তারা।
মতবিনিময় সভায় স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা দৃঢ়ভাবে উল্লেখ করেন, "পুলিশে আবার তেলবাজির ধারা চালু করার চেষ্টা চলছে। এটা এখনই বন্ধ করতে হবে। রাষ্ট্রীয় আইন-শৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্বে যারা থাকবে, তাদের উচিত হবে সম্মানের সঙ্গে দায়িত্ব পালন, তোষামোদ নয়।"
তিনি বলেন, “আমাদের দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকেই পুলিশে নিয়োগ বাণিজ্য বন্ধ করা সম্ভব হয়েছে, বদলি বাণিজ্যও নিয়ন্ত্রণে এসেছে। এসব দুর্নীতির চর্চা কেউ আবার ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করলে, তা বরদাশত করা হবে না।”
৫ আগস্টের গণঅভ্যুত্থানের সময় লুট হওয়া অস্ত্র উদ্ধারে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে কাজ শুরু করার নির্দেশ দিয়ে তিনি বলেন, "এই অস্ত্রগুলো রাষ্ট্রের নিরাপত্তার জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়াতে পারে। পাশাপাশি যারা জামিনে মুক্ত হয়ে সন্ত্রাসী কার্যক্রমে জড়াচ্ছে, তাদের নজরে রাখতে হবে।"
মাদকের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতির কথা পুনর্ব্যক্ত করে তিনি বলেন, "আমরা মাদক নিরাময়কেন্দ্র খুলে দায় শেষ করতে চাই না। আমরা চাই মাদক চিরতরে নির্মূল হোক। মাদকবিরোধী অ্যাকশন না নিলে পুলিশে চাকরি থাকবে না। ওসিদের ঘুষ নেওয়ার অভ্যাসও এখনই বন্ধ করতে হবে।"
আইন-শৃঙ্খলা রক্ষায় কমিউনিটি পুলিশিং ব্যবস্থাকে কার্যকর করতে প্রশাসনকে আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, "পুলিশ প্রশাসনকে এখন আর ঐতিহ্যগত ধারা ধরে রেখে চললে হবে না। জনগণের সঙ্গে সম্পৃক্ত থেকে, তাদের আস্থা অর্জন করেই আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা করতে হবে। কমিউনিটি পুলিশিং একটি শক্তিশালী ব্যবস্থা, এটাকে আরও জোরদার করতে হবে।"
সরকারি কাজে তদবিরের প্রবণতা সম্পর্কে হালকা হাস্যরসের সঙ্গে কঠিন বার্তা দিয়ে উপদেষ্টা বলেন, “উপদেষ্টা হওয়ার পর আমার আত্মীয়-স্বজনের সংখ্যা হঠাৎ করে বেড়ে গেছে। এমনকি যাদের অনেককে আমি চিনিও না, তারা নানাভাবে তদবির করছে। তাই কেউ যদি আমার নাম ভাঙিয়ে তদবির করতে আসে, তাকে চা-নাশতা খাওয়ান, তারপর আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে তুলে দিন।”
তিনি আরও যোগ করেন, "এই তদবিরপ্রথা আমাদের প্রশাসনিক স্বচ্ছতার সবচেয়ে বড় বাধা। এটা বন্ধ করতে না পারলে যে কোনো সংস্কারই ব্যর্থ হবে।"
মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী প্রশাসনের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের উদ্দেশ্যে বলেন, “আমাদের সময় হাতে কম। কাজেই এখন আর গড়িমসি চলবে না। সবাইকে দায়িত্ববান হতে হবে। আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নয়ন ছাড়া সাধারণ মানুষের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সম্ভব নয়।”
তিনি প্রত্যেক কর্মকর্তা ও সংস্থাকে নির্ধারিত দায়িত্ব যথাযথভাবে পালনের আহ্বান জানিয়ে বলেন, "নিয়োগ, বদলি, পদোন্নতি—সব কিছুতে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে হবে। নইলে ভবিষ্যতে প্রশাসনিক কাঠামো তছনছ হয়ে যাবে।"
এর আগে সকালে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা ও আরও দুই উপদেষ্টা যশোর জেলার বন্যা ও জলাবদ্ধতায় ভুক্তভোগী এলাকা ভবদহ পরিদর্শনে যান। সেখানে তারা সরাসরি ক্ষতিগ্রস্তদের সঙ্গে কথা বলেন এবং স্থানীয় প্রশাসনকে দ্রুত সমাধানের নির্দেশ দেন।
স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার বক্তব্য ও নির্দেশনা স্পষ্টভাবে নির্দেশ করে যে, বর্তমান প্রশাসন পুলিশ ও আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর কার্যক্রমে স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা ও জনসম্পৃক্ততা নিশ্চিত করতে চায়। সিভিল ড্রেসে গ্রেফতার নিষিদ্ধ করা, মাদক-সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান, তদবির-দুর্নীতি বন্ধের বার্তা এবং কমিউনিটি পুলিশিং জোরদারের নির্দেশ—এসবই প্রমাণ করে, প্রশাসনিক সংস্কারের জন্য এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হতে যাচ্ছে।
বাংলাবার্তা/এমএইচ