
ছবি: সংগৃহীত
দীর্ঘদিন ধরে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে থাকা শেখ হাসিনা ও তার পরিবারের সদস্যদের দেশে ফিরিয়ে এনে বিচারের আওতায় আনার প্রক্রিয়া অবশেষে আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। এই উদ্যোগের মধ্য দিয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের আমলে চলমান শুদ্ধি অভিযানের আরেকটি নতুন অধ্যায় সূচিত হলো।
মঙ্গলবার (২২ এপ্রিল) রাজধানীর সেগুনবাগিচায় দুদক কার্যালয়ে সাংবাদিকদের মুখোমুখি হয়ে কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) হাফিজ আহসান ফরিদ এ বিষয়ে বিস্তারিত তথ্য তুলে ধরেন। তিনি বলেন, "শেখ হাসিনার মেয়ে টিউলিপ সিদ্দিকীসহ যেসব ব্যক্তি বাংলাদেশি নাগরিক হিসেবে অপরাধে জড়িত, তাদের প্রত্যাবর্তন নিশ্চিত করে বিচার প্রক্রিয়ার আওতায় আনা হবে। আমরা আন্তর্জাতিক সহযোগিতার মাধ্যমে এ বিষয়ে পদক্ষেপ নিচ্ছি।"
পালিয়ে যাওয়া ও মামলার পটভূমি
গত বছরের ৫ আগস্ট ছাত্র ও জনতার গণঅভ্যুত্থানে চাপে পড়ে ভারতের পশ্চিমবঙ্গে আশ্রয় নেন শেখ হাসিনা। আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর তার বিরুদ্ধে দেশজুড়ে শুরু হয় তদন্ত এবং মামলা। তদন্তে উঠে আসে বিভিন্ন অভিযোগ, যার মধ্যে রয়েছে—রাজনৈতিক বিরোধীদের গুম ও হত্যা, ব্যাপক দুর্নীতি, রাষ্ট্রীয় অর্থ আত্মসাৎ, নথিপত্র জালিয়াতি এবং প্রশাসনিক ক্ষমতার চরম অপব্যবহার।
এই অভিযোগগুলোর প্রেক্ষিতে অন্তর্বর্তী সরকারের আমলে একাধিক মামলা দায়ের হয় শেখ হাসিনা এবং তার ঘনিষ্ঠ আত্মীয়দের বিরুদ্ধে। এসব মামলায় বিভিন্ন আদালত থেকে একের পর এক গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি হয়। ইতোমধ্যে শেখ হাসিনার পাসপোর্ট বাতিল করা হয়েছে, ফলে তিনি আর বৈধভাবে বিদেশ থেকে বাংলাদেশে প্রবেশ করতে পারেন না।
এনআইডি লক ও প্রশাসনিক পদক্ষেপ
শুধু মামলা কিংবা পাসপোর্ট বাতিলেই থেমে থাকেনি কার্যক্রম। নির্বাচন কমিশন (ইসি) শেখ হাসিনার পরিবারের অন্তত ১০ সদস্যের জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি) ‘লক’ করে দিয়েছে। এই পদক্ষেপের ফলে তারা আর কোনো ধরনের নাগরিক সুবিধা গ্রহণ করতে পারছেন না, যেমন ব্যাংক হিসাব খোলা, সম্পত্তি হস্তান্তর, ভ্রমণ ডকুমেন্ট ব্যবহার ইত্যাদি।
ইসির জাতীয় পরিচয় নিবন্ধন অনুবিভাগের মহাপরিচালক মুহাম্মদ আশরাফ হোসেনের স্বাক্ষরিত এক নির্দেশনায় উল্লেখ করা হয়, ফেব্রুয়ারি মাসেই সরকারের বিশেষ নির্দেশে এসব এনআইডি সিস্টেম থেকে লক করা হয়েছে। শেখ হাসিনার সঙ্গে যেসব নিকটাত্মীয় বিদেশে আছেন এবং রাষ্ট্রবিরোধী অপরাধে জড়িত বলে সন্দেহ রয়েছে, তাদের ক্ষেত্রেও একই প্রক্রিয়া অনুসরণ করা হচ্ছে।
দুদকের বর্তমান কার্যক্রম
দুদক কমিশনার জানান, তাদের কার্যক্রমের লক্ষ্য কেবল দেশে ফিরিয়ে আনা নয়; বরং ফিরিয়ে এনে একটি স্বচ্ছ ও নিরপেক্ষ বিচার নিশ্চিত করা। ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) হাফিজ আহসান ফরিদ বলেন, "আমরা ইতোমধ্যে ইন্টারপোল, আন্তর্জাতিক কনভেনশন, ও অন্যান্য আইনগত উপায়ে যোগাযোগ শুরু করেছি। তাদের ফিরিয়ে আনা আমাদের জাতীয় দায়িত্ব।"
তিনি আরও বলেন, “দেশে যে শুদ্ধি অভিযান চলছে, তাতে কোনো রকম পক্ষপাতিত্ব থাকবে না। আইন সবার জন্য সমান। শেখ হাসিনা ও তার পরিবারের সদস্যদের নাম যতই বড় হোক না কেন, তারা যদি অপরাধে জড়িত হন, তাহলে দেশের মাটিতে দাঁড়িয়ে তাদের বিচার হতেই হবে।”
জনমত ও রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়া
আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর থেকেই বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, নাগরিক সংগঠন ও ভুক্তভোগীরা শেখ হাসিনাকে দেশে ফিরিয়ে এনে বিচারের আওতায় আনার দাবি করে আসছিলেন। গণফোরাম, বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি), এবং বাম গণতান্ত্রিক জোট একাধিকবার সংবাদ সম্মেলনে এ বিষয়ে সরকারের কাছে জবাবদিহি চেয়েছে।
কনজুমারস অ্যাসোসিয়েশন, ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি), এবং আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক)সহ বিভিন্ন নাগরিক সংগঠনও আদালতের নির্দেশনাগুলো বাস্তবায়নে প্রশাসনের গতি না থাকায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। তবে সম্প্রতি দুদক যেভাবে সক্রিয় হয়েছে, তাতে জনমনে আশার সঞ্চার হয়েছে।
আন্তর্জাতিক বাধা ও সম্ভাবনা
তবে শেখ হাসিনাকে দেশে ফিরিয়ে আনার প্রক্রিয়া খুব সহজ হবে না বলে ধারণা করছেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ও মানবাধিকার বিশেষজ্ঞরা। কারণ, টিউলিপ সিদ্দিকীর মতো সদস্যরা ব্রিটিশ নাগরিকত্বধারী। এক্ষেত্রে তাদের বিরুদ্ধে কী ধরনের আন্তর্জাতিক আইন প্রয়োগ করা যায়, সেটি নির্ভর করছে কূটনৈতিক সম্পর্ক, দ্বিপাক্ষিক চুক্তি এবং অপরাধের ধরনের ওপর।
তবে দুদক আশাবাদী যে তারা প্রয়োজনীয় তথ্য-প্রমাণ ও আইনি যুক্তি উপস্থাপন করে আন্তর্জাতিক আদালত ও সংস্থাগুলোর সহযোগিতা আদায়ে সক্ষম হবে।
শেখ হাসিনা ও তার পরিবারের বিরুদ্ধে দায়ের হওয়া মামলা এবং বিচার প্রক্রিয়া এখন দেশের জন্য একটি বড় পরীক্ষা। শাসনব্যবস্থা কতটা ন্যায়ভিত্তিক এবং রাজনীতি কতটা দায়বদ্ধ, তা অনেকটাই নির্ভর করবে এই উদ্যোগের সফলতার ওপর।
দুদকের এই উদ্যোগ শুধুই এক ব্যক্তির বিরুদ্ধে নয়, বরং একটি দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়নের বিরুদ্ধে প্রতীকী লড়াই—এমনটাই মনে করছেন বিশ্লেষকরা। এখন দেখার পালা, আন্তর্জাতিক পর্যায়ে কূটনৈতিক বাধা পেরিয়ে শেখ হাসিনা ও তার পরিবারের সদস্যদের দেশে ফিরিয়ে এনে আইনের মুখোমুখি দাঁড় করানো সম্ভব হয় কি না।
বাংলাবার্তা/এমএইচ