
ছবি: সংগৃহীত
বিশ্বব্যাপী রোহিঙ্গা সংকট এবং বাস্তুচ্যুত জনগোষ্ঠীর মানবিক ও রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে দোহায় আয়োজিত গোলটেবিল আলোচনায় বক্তব্য প্রদান করেছেন বাংলাদেশ সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস। তিনি রোহিঙ্গা সংকটকে শুধুমাত্র একটি মানবিক সমস্যা নয়, বরং একটি বহুমাত্রিক সংকট হিসেবে অভিহিত করেছেন, যার সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক এবং পরিবেশগত দিক রয়েছে। তিনি বলেন, এই সংকটের একমাত্র কার্যকর সমাধান হচ্ছে টেকসই প্রত্যাবাসন, যা মিয়ানমারের রাখাইন অঞ্চলে ফিরে যাওয়ার পাশাপাশি সেই অঞ্চলের শান্তি এবং স্থিতিশীলতার জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়ার মাধ্যমে সম্ভব।
এদিনের গোলটেবিল আলোচনায় কাতার ফাউন্ডেশন এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের নেতৃবৃন্দের উপস্থিতি ছিল, যেখানে রোহিঙ্গাদের অবস্থান এবং সংকটের গভীরতা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়েছে। ড. ইউনূস তাঁর বক্তব্যে বলেন, “রোহিঙ্গা সংকট কেবল একটি মানবিক জরুরি অবস্থা নয়, বরং এটি দক্ষিণ এশিয়ার ভূ-রাজনৈতিক পরিস্থিতি এবং আঞ্চলিক নিরাপত্তা সম্পর্কে গভীর প্রভাব ফেলছে। এই পরিস্থিতি মোকাবিলায় একটি সমন্বিত কৌশল প্রয়োজন।”
বাংলাদেশে আশ্রিত ১৩ লাখ রোহিঙ্গা: মানবিক চ্যালেঞ্জ
প্রধান উপদেষ্টা আরও উল্লেখ করেন যে, বাংলাদেশ প্রায় ১৩ লাখ রোহিঙ্গাকে আশ্রয় দিয়েছে এবং প্রতি বছর প্রায় ৩২ হাজার নতুন রোহিঙ্গা নবজাতকের জন্ম নিচ্ছে। তিনি বলেন, "বাংলাদেশ শুধুমাত্র মানবিক কারণে এই বিশাল জনগোষ্ঠীকে আশ্রয় দিয়েছে।" তবে, তিনি একথাও স্পষ্ট করেন যে, রোহিঙ্গা সংকটের সমাধান শুধুমাত্র শরণার্থী শিবিরে তাদের দীর্ঘমেয়াদী বসবাসের মাধ্যমে সম্ভব নয়। একমাত্র কার্যকর সমাধান হলো টেকসই প্রত্যাবাসন, যেখানে মিয়ানমারের রাখাইন অঞ্চলে রোহিঙ্গাদের নিরাপত্তা এবং জীবিকার পুনর্স্থাপন নিশ্চিত করা হবে।
রাখাইন অঞ্চলের পরিস্থিতি
ড. ইউনূস বলেন, রাখাইনের পরিস্থিতি একেবারে নাটকীয়ভাবে পরিবর্তিত হয়েছে। আরাকান আর্মি (এএ) বর্তমানে মিয়ানমার-বাংলাদেশ সীমান্তের ২৭১ কিলোমিটার এলাকা এবং রাখাইনের ১৭টি টাউনশিপের মধ্যে ১৪টি নিয়ন্ত্রণ করছে। এটি সংকটের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ মাত্রা, যা রোহিঙ্গাদের নিরাপদ প্রত্যাবাসনকে আরও জটিল করে তুলছে।
তিনি আরও জানান, ২০২৫ সালের ফেব্রুয়ারির তথ্যানুযায়ী, রাখাইনে মোট অভ্যন্তরীণ বাস্তুচ্যুত মানুষের সংখ্যা ৫ লাখ ৩৮ হাজার ৮৭৬ জন, এর মধ্যে ১ লাখ ৫২ হাজার ৭১ জন রাষ্ট্রহীন রোহিঙ্গা, যাদের মধ্যে অনেকে দীর্ঘমেয়াদীভাবে ২১টি ক্যাম্প ও তিনটি গ্রামে বসবাস করছে। নতুন করে বাস্তুচ্যুত ৩ লাখ ৮৬ হাজার ৮০৫ জন (অধিকাংশ রাখাইন) বর্তমানে ১ হাজার ২১৯টি স্থানে ছড়িয়ে রয়েছে।
২০২৪ সালে নতুন রোহিঙ্গার আগমন
প্রধান উপদেষ্টা বলেন, গত নভেম্বরে বাংলাদেশে নতুন ১ লাখ রোহিঙ্গা প্রবেশ করেছে, এবং ফেব্রুয়ারিতে আরাকান আর্মির হামলার ফলে ৯০৯ জন মিয়ানমার নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যও বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে। যদিও বেশিরভাগই ফেরত পাঠানো হয়েছে, তবে পরিস্থিতি এখনও নিয়ন্ত্রণের বাইরে।
অর্থায়ন সংকট: মানবিক সহায়তা সংকুচিত হচ্ছে
অধ্যাপক ইউনূস উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেন, রোহিঙ্গা মানবিক সংকট মোকাবিলার জন্য যৌথ সহায়তা পরিকল্পনার (জেআরপি) অর্থায়ন গত কয়েক বছরে ক্রমাগত হ্রাস পাচ্ছে। ২০২৪ সালে জেআরপির জন্য ৮৫২ দশমিক ৪ মিলিয়ন ডলার অনুদান আহ্বান করা হয়েছিল, কিন্তু ৬৪ দশমিক ৪ শতাংশ অর্থায়ন প্রাপ্ত হয়েছে, যা মোট ৫৪৮ দশমিক ৯ মিলিয়ন ডলার। ২০২৫-২৬ সালের জন্য প্রয়োজন ৯৩৪ দশমিক ৫ মিলিয়ন ডলার, কিন্তু আন্তর্জাতিক সহায়তা পূর্বাভাস অনুযায়ী কমে যেতে পারে।
বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি (ডাব্লুএফপি) সম্প্রতি ঘোষণা করেছে যে, তারা ২০২৫ সালের এপ্রিল থেকে খাদ্য সহায়তা বন্ধ করতে পারে। তবে সাময়িকভাবে কিছু তহবিল পাওয়া গেছে, যার মাধ্যমে সহায়তা স্থগিত রাখা হয়েছে, কিন্তু সেপ্টেম্বর ২০২৫ থেকে পরিস্থিতি আরও জটিল হয়ে উঠতে পারে।
আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সহায়তা
ড. ইউনূস আশা প্রকাশ করেন যে, বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সহায়তা পাবে, এবং বিশেষ করে কাতার এই বিষয়ে অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে পারে। তিনি বলেন, "আমরা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সঙ্গে কাজ করছি, যাতে এই সংকট মোকাবিলার জন্য প্রয়োজনীয় অর্থায়ন নিশ্চিত করা যায়। কাতার এই ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।"
প্রধান উপদেষ্টা আরও বলেন, বাংলাদেশ কেবল নিজের সীমিত সামর্থ্য দিয়ে এই মানবিক সংকট মোকাবিলা করছে, কিন্তু দীর্ঘমেয়াদী সমাধান কেবল রোহিঙ্গাদের টেকসই প্রত্যাবাসনেই নিহিত। এর জন্য আন্তর্জাতিক সমর্থন এবং সহযোগিতার প্রয়োজন, যাতে রাখাইন অঞ্চলের পরিবেশ, নিরাপত্তা এবং অর্থনৈতিক পরিস্থিতি পুনর্গঠিত হতে পারে।
রোহিঙ্গা সংকট একদম মানবিক সংকটের সীমা ছেড়ে রাজনৈতিক ও আঞ্চলিক নিরাপত্তা প্রশ্নের সাথে যুক্ত হয়ে পড়েছে। ড. ইউনূস এই সংকটের একটি স্থায়ী সমাধান হিসেবে টেকসই প্রত্যাবাসনকে চিহ্নিত করেছেন, যা শুধু বাংলাদেশ নয়, পুরো দক্ষিণ এশিয়ার জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ। তবে তিনি আশা প্রকাশ করেন যে, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় একযোগভাবে এই সমস্যার সমাধানে এগিয়ে আসবে এবং কাতারের মতো দেশগুলো বিশেষ ভূমিকা পালন করবে।
বাংলাবার্তা/এমএইচ