
ছবি: সংগৃহীত
বিশ্বের খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের আধ্যাত্মিক নেতা ও রোমান ক্যাথলিক চার্চের পোপ ফ্রান্সিসের শেষকৃত্যে যোগ দিতে দোহা থেকে ইতালির রাজধানী রোমে যাচ্ছেন বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস।
সরকারি সফরের অংশ হিসেবে বর্তমানে কাতারের রাজধানী দোহায় অবস্থান করছেন তিনি। সেখান থেকেই আগামী শুক্রবার সকালে রোমের উদ্দেশ্যে রওনা হবেন বলে নিশ্চিত করেছেন প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম।
প্রেস সচিব জানান, পোপ ফ্রান্সিসের সঙ্গে অধ্যাপক ইউনূসের বহু বছর ধরে একটি অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ ও আন্তরিক সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। নানা বৈশ্বিক ইস্যুতে তারা একাধিকবার একে অপরের সঙ্গে আলোচনায় বসেছেন, বিশেষ করে দারিদ্র্য বিমোচন, পরিবেশ ও জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলা এবং বিশ্ব শান্তি প্রতিষ্ঠার মতো মানবিক ও নৈতিক ইস্যুতে তাদের মতাদর্শিক মিল ছিল বেশ লক্ষণীয়। এই সম্পর্কের পরিপ্রেক্ষিতেই বন্ধুর প্রতি শেষ শ্রদ্ধা জানাতে এবং মানবতার এক অনন্য পথপ্রদর্শককে সম্মান জানাতে রোমে অনুষ্ঠিতব্য পোপের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় যোগ দিচ্ছেন প্রধান উপদেষ্টা।
আগামী শনিবার (২৭ এপ্রিল) রোমে পোপ ফ্রান্সিসের রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া অনুষ্ঠিত হবে। ভ্যাটিকান সিটির সেন্ট পিটার্স ব্যাসিলিকার পবিত্র চত্বরে অনুষ্ঠিতব্য এই অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় অংশ নেবেন বিশ্বের বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্র ও সরকারপ্রধান, ধর্মীয় নেতা ও বিশিষ্টজনেরা। সেখানে বাংলাদেশ থেকেও অধ্যাপক ইউনূসের এই অংশগ্রহণ কূটনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ বলে বিবেচনা করা হচ্ছে।
প্রেস সচিব আরও জানান, অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় অংশগ্রহণের বাইরে প্রধান উপদেষ্টার রোম সফরে কোনো আনুষ্ঠানিক বৈঠক বা রাষ্ট্রীয় কর্মসূচি নির্ধারিত নেই। এটি মূলত একটি মানবিক ও ব্যক্তিগত শ্রদ্ধা নিবেদনের সফর হিসেবেই অনুষ্ঠিত হচ্ছে।
সফর শেষে আগামী রোববার (২৮ এপ্রিল) অধ্যাপক ইউনূসের বাংলাদেশে ফেরার কথা রয়েছে।
পোপ ফ্রান্সিস: শান্তির দূত ও জনমুখী ধর্মনেতা
গত সোমবার (২২ এপ্রিল) পোপ ফ্রান্সিস পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করেন। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৮৮ বছর। তিনি ২০১৩ সালে পোপ নির্বাচিত হয়ে প্রায় ১২ বছর ধরে রোমান ক্যাথলিক গির্জার সর্বোচ্চ নেতা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন।
পোপ ফ্রান্সিস ছিলেন আর্জেন্টিনার নাগরিক এবং প্রথম লাতিন আমেরিকান যিনি এই পদে অধিষ্ঠিত হন। পুরো সময়জুড়ে তিনি ছিলেন মানবতা, দরিদ্র জনগোষ্ঠী এবং সংলাপভিত্তিক ধর্মীয় সহাবস্থানের এক উজ্জ্বল প্রতীক। জলবায়ু পরিবর্তন, অর্থনৈতিক বৈষম্য, উদ্বাস্তু সংকট ও যুদ্ধবিরোধী বার্তার জন্য তিনি বিশ্বজুড়ে ব্যাপক প্রশংসিত হন।
বাংলাদেশের সঙ্গেও তার সম্পর্ক ছিল অত্যন্ত হৃদ্যতাপূর্ণ। ২০১৭ সালে তিনি বাংলাদেশ সফর করেন, যেখানে তিনি রোহিঙ্গা শরণার্থীদের সঙ্গে সরাসরি সাক্ষাৎ করে বিশ্ব বিবেককে নাড়া দেন। তার ঐ সফরে বাংলাদেশের সমাজ ও মানবাধিকারের বিভিন্ন বিষয়েও তিনি উদ্বেগ প্রকাশ করেছিলেন।
কূটনৈতিক গুরুত্ব ও ব্যক্তিগত দায়বদ্ধতা
অধ্যাপক ইউনূস, যিনি একজন নোবেল বিজয়ী ও বিশ্বব্যাপী শান্তি ও উন্নয়নের প্রতীক হিসেবে বিবেচিত, তার এই সফর আন্তর্জাতিক পরিসরে বাংলাদেশের অবস্থানকে আরও মানবিক ও মূল্যবোধভিত্তিক রাষ্ট্র হিসেবে উপস্থাপন করবে বলে কূটনৈতিক মহলে আলোচনা চলছে।
যদিও তিনি বর্তমানে একটি অন্তর্বর্তী সরকারে প্রধান উপদেষ্টার দায়িত্বে রয়েছেন, তবুও এই সফরকে অনেকে তার ব্যক্তিগত ও নৈতিক দায়বদ্ধতা বলেও বিবেচনা করছেন। তার উপস্থিতি একদিকে পোপের অবদানের প্রতি সম্মান, অন্যদিকে পারস্পরিক ধর্মীয় সহাবস্থান ও আন্তঃধর্মীয় সংলাপের প্রতীকী অভিব্যক্তি।
বিশ্বজুড়ে সংঘাত, ধর্মীয় অসহিষ্ণুতা ও মানবিক সংকটের প্রেক্ষাপটে অধ্যাপক ইউনূসের এই সফর নিঃসন্দেহে বিশ্ব বিবেকের কাছে একটি তাৎপর্যপূর্ণ বার্তা পৌঁছে দেবে—শান্তি, সহনশীলতা ও বন্ধুত্বই পারে আমাদের জাতি ও ধর্মের সীমানা পেরিয়ে মানুষকে একত্রিত করতে।
বাংলাবার্তা/এমএইচ