
ছবি: সংগৃহীত
বাংলাদেশের তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি (আইসিটি) খাতের বিগত সময়কার নানা প্রকল্পে দুর্নীতি, অনিয়ম ও অপব্যবস্থাপনার অভিযোগের তদন্ত এবং এই খাতের বাস্তবচিত্র ও ভবিষ্যৎ করণীয় উপস্থাপন করতে একটি উচ্চপর্যায়ের টাস্কফোর্স গঠন করেছে সরকার। এই টাস্কফোর্সের অন্যতম উদ্দেশ্য হবে একটি ‘আইসিটি শ্বেতপত্র’ প্রণয়ন ও তা জনসমক্ষে উপস্থাপন করা।
ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয় বৃহস্পতিবার (২৪ এপ্রিল) এক বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে এ তথ্য জানায়। এর আগে গত ১৭ এপ্রিল গেজেট আকারে টাস্কফোর্স গঠনের ঘোষণা প্রকাশিত হয়।
নতুন গঠিত এই টাস্কফোর্সের নেতৃত্বে রয়েছেন প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ ও শিক্ষাবিদ প্রফেসর ড. নিয়াজ আসাদুল্লাহ। টাস্কফোর্সের অন্য সদস্যরা হচ্ছেন—যুক্তরাষ্ট্রের পার্ডু বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও সেমিকন্ডাক্টর ও আইওটি বিশেষজ্ঞ মুহাম্মদ মুস্তাফা হোসেন, আইন বিশেষজ্ঞ ব্যারিস্টার আফজাল জামি সৈয়দ আলী, প্রযুক্তি সাংবাদিক মো. শরিয়ত উল্যাহ, এবং প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ মাহমুদ সালাম মারুফ। প্রধান সমন্বয়কারী হিসেবে যুক্ত হয়েছেন আইটি বিশেষজ্ঞ আসিফ শাহরিয়ার সুস্মিত।
টাস্কফোর্সের কার্যপরিধি সম্পর্কে গেজেটে বলা হয়েছে, তারা ২০০৯ সাল থেকে আইসিটি খাতে গৃহীত সব প্রকল্প, চুক্তি, সংশ্লিষ্ট উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাবনা (ডিপিপি), নিরীক্ষা প্রতিবেদন এবং বিগত সরকারের সময়ে যেসব তদন্ত হয়েছে, সেসব নথি ও প্রক্রিয়া বিশ্লেষণ করে প্রকৃত দুর্নীতি ও অনিয়মের চিত্র নির্ধারণ করবে। সেইসঙ্গে তারা নীতিগত সুপারিশ, আইনি সংস্কার ও ভবিষ্যৎ প্রযুক্তিনির্ভর উন্নয়নের জন্য প্রাসঙ্গিক দিকনির্দেশনা প্রদান করবে।
টাস্কফোর্সকে আগামী ২১ জুনের মধ্যে একটি খসড়া শ্বেতপত্র ও বিস্তারিত প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়েছে। এই প্রতিবেদনে তারা প্রকল্পভিত্তিক অনিয়মের পাশাপাশি আইসিটি খাতে দীর্ঘদিন ধরে চলা প্রশাসনিক ও কাঠামোগত দুর্বলতাগুলোকেও বিশ্লেষণ করবে।
টাস্কফোর্সের সদস্যরা বিধি অনুযায়ী সম্মানী বা সিটিং এলাউন্স পাবেন এবং তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগ থেকে তারা প্রয়োজনীয় কারিগরি ও লজিস্টিক সহায়তা গ্রহণ করতে পারবেন। বিভাগের উপ-সচিব মো. আবু নাছের টাস্কফোর্সের প্রশাসনিক সহায়তার দায়িত্বে থাকবেন।
টাস্কফোর্স সদস্যদের পটভূমি
টাস্কফোর্সের প্রধান প্রফেসর ড. নিয়াজ আসাদুল্লাহ একজন আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন উন্নয়ন অর্থনীতিবিদ। তিনি অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি অর্জন করে বর্তমানে নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসরিয়াল ফেলো হিসেবে কর্মরত আছেন। তিনি শিক্ষা, দারিদ্র্য নিরসন ও সামাজিক উন্নয়ন বিষয়ে দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় বিস্তৃতভাবে কাজ করেছেন।
মুহাম্মদ মুস্তাফা হোসেন, যিনি সেমিকন্ডাক্টর প্রযুক্তি ও ইন্টারনেট অব থিংস (IoT) ক্ষেত্রে একজন স্বীকৃত গবেষক, বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের পার্ডু বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক। তিনি ইউনিভার্সিটি অব টেক্সাস অ্যাট অস্টিন থেকে ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে পিএইচডি সম্পন্ন করেন।
আইনজীবী ব্যারিস্টার আফজাল জামি সৈয়দ আলী লন্ডনের কাপলান হলবর্ন কলেজ থেকে এলএলবি এবং উলভার হ্যাম্পটন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এলএলএম করেন। তিনি আন্তর্জাতিক আইন, প্রতিরক্ষা মামলা ও জালিয়াতি সংক্রান্ত মামলায় বিশেষজ্ঞ।
সাংবাদিক মো. শরিয়ত উল্যাহ বাংলাদেশের প্রযুক্তি সাংবাদিকতায় এক পরিচিত নাম। তিনি দৈনিক ইত্তেফাক ও বণিক বার্তায় কাজ করার পর বর্তমানে দৈনিক আজকের বাংলার পরিকল্পনা সম্পাদক। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতায় স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেছেন।
প্রধান সমন্বয়কারী আসিফ শাহরিয়ার সুস্মিত একজন স্বনামধন্য প্রযুক্তি পরামর্শক, যিনি দেশের বিভিন্ন প্রযুক্তি নীতিমালা ও প্রকল্পে পরামর্শ দিয়ে আসছেন।
আইসিটি শ্বেতপত্র: একটি যুগান্তকারী দলিলের পথে
সরকারের এই উদ্যোগকে তথ্যপ্রযুক্তি খাতের বিশেষজ্ঞ ও বিশ্লেষকরা স্বাগত জানিয়ে বলছেন, দেশের ডিজিটাল রূপান্তর প্রক্রিয়া যেন কেবল রাজনৈতিক শ্লোগানে সীমাবদ্ধ না থাকে, সেজন্য বিগত প্রকল্পগুলোর স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতেই এই শ্বেতপত্র গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।
বিশেষ করে ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ শীর্ষক কর্মসূচির আওতায় বিভিন্ন ব্যয়বহুল প্রকল্প—যেমন শিক্ষা উপকরণ ডিজিটালাইজেশন, স্মার্ট কার্ড বিতরণ, ই-গভর্নেন্স, ফাইবার অপটিকস সম্প্রসারণ ইত্যাদিতে কী পরিমাণ বাজেট ব্যয় হয়েছে এবং সেই খাতে কতটা জনসেবা পৌঁছেছে—এই প্রশ্নগুলোর জবাব খুঁজবে টাস্কফোর্স।
একইসঙ্গে তারা ভবিষ্যতের জন্য একটি বাস্তবসম্মত ও টেকসই প্রযুক্তিনির্ভর উন্নয়ন কাঠামো প্রস্তাব করবেন, যাতে সরকারের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনাগুলো আরও দক্ষতার সঙ্গে বাস্তবায়ন করা যায়।
এই শ্বেতপত্রকে ঘিরে আগামী সপ্তাহগুলোতে রাজনৈতিক ও নীতিনির্ধারক মহলে ব্যাপক আলোচনা শুরু হতে পারে বলেও মনে করা হচ্ছে। তথ্যপ্রযুক্তি খাতের অতীত অনিয়ম থেকে শিক্ষা নিয়ে ভবিষ্যতের জন্য স্বচ্ছ ও জনমুখী নীতি নির্ধারণে এই উদ্যোগ একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ হয়ে উঠতে পারে।
বাংলাবার্তা/এমএইচ