
ছবি: সংগৃহীত
নির্বাচন ব্যবস্থায় যে সব সংস্কার নির্বাচন কমিশনের (ইসি) এক্তিয়ারভুক্ত—সেগুলো দ্রুত বাস্তবায়ন করবে কমিশন। তবে রাজনৈতিকভাবে সংবেদনশীল বা বিতর্কিত সংস্কারগুলোর ক্ষেত্রে জাতীয় ঐকমত্য গড়ে তোলার আহ্বান জানিয়েছেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) এএমএম নাসির উদ্দিন। বৃহস্পতিবার (২৪ এপ্রিল) রাজধানীর আগারগাঁওয়ে নির্বাচন ভবনে অস্ট্রেলিয়ার নবনিযুক্ত হাইকমিশনার সুসান রাইলির সঙ্গে বৈঠক শেষে এসব কথা বলেন তিনি।
রাজনৈতিক সংস্কারে ইসির সীমাবদ্ধতা
সিইসি বলেন, "সব সংস্কার ইসির একার পক্ষে বাস্তবায়ন সম্ভব নয়। যেগুলো নির্বাচন কমিশনের এখতিয়ারে আছে—আমরা করছি এবং করবো। কিন্তু কিছু সংস্কার রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা বহন করে, যেগুলোতে ইসির সীমাবদ্ধতা আছে। এ ধরনের সংস্কার জাতীয় ঐকমত্যের ভিত্তিতে করতে হবে।"
তিনি আরও বলেন, “নির্বাচনের পরিবেশ সবার জন্য সমান এবং গ্রহণযোগ্য করতে হলে রাজনৈতিক দলগুলোর অংশগ্রহণ এবং আস্থাও প্রয়োজন। তাই রাজনৈতিক সংস্কার ইসির একক সিদ্ধান্তে বাস্তবায়ন সম্ভব নয়।”
জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রস্তুতি
সিইসি জানান, আসন্ন ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে কমিশন ইতোমধ্যে একাধিক প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছে। “ভোটার তালিকা হালনাগাদ করা হয়েছে, নতুন প্রযুক্তির প্রয়োগ নিয়ে চিন্তাভাবনা চলছে এবং নির্বাচনী আচরণবিধি সংস্কারের কাজ এগোচ্ছে। এছাড়া সংসদীয় আসনের সীমানা পুনর্নির্ধারণ কার্যক্রমও প্রায় শেষ পর্যায়ে,” বলেন তিনি।
তিনি আরও উল্লেখ করেন, “আমরা রাজনৈতিক দলগুলোর নিবন্ধন কার্যক্রমের সময়সীমা বাড়িয়েছি, যেন নতুন রাজনৈতিক শক্তিগুলোও নির্বাচনী রাজনীতিতে অংশ নিতে পারে।”
অস্ট্রেলিয়ার সমর্থনের আশ্বাস
অস্ট্রেলিয়ার হাইকমিশনার সুসান রাইলি বলেন, “আমাদের বৈঠক অত্যন্ত ফলপ্রসূ হয়েছে। আমরা বাংলাদেশ নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে কাজ করতে আগ্রহী এবং অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় সহায়তা দিতে প্রস্তুত।”
তিনি আরও বলেন, “বাংলাদেশ একটি গুরুত্বপূর্ণ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র। এ দেশে নির্বাচন প্রক্রিয়া যত স্বচ্ছ ও অংশগ্রহণমূলক হবে, ততই জনগণের আস্থা বাড়বে এবং গণতন্ত্রের ভিত্তি শক্তিশালী হবে। অস্ট্রেলিয়া এই প্রক্রিয়ায় অংশীদার হতে চায়।”
বিশ্লেষকদের প্রতিক্রিয়া
নির্বাচন বিশেষজ্ঞ ও সাবেক নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) সাখাওয়াত হোসেন বলেন, “সিইসি’র বক্তব্যে একটা বাস্তবতা আছে। রাজনৈতিক সংস্কার ইসির একক দায়িত্ব নয়। এ ধরনের সিদ্ধান্ত নিতে হলে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সংলাপ ও সমঝোতা জরুরি।”
তিনি আরও বলেন, “নির্বাচন ব্যবস্থায় স্বচ্ছতা আনতে যেসব সংস্কার এখনই করা সম্ভব—যেমন আচরণবিধি কঠোর করা, মনোনয়ন যাচাইয়ের প্রক্রিয়া উন্নত করা, সেসব দ্রুত বাস্তবায়ন দরকার।”
বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক ড. তানজিমা সুলতানা বলেন, “ইসির শক্ত অবস্থান নেওয়া জরুরি। দলগুলো যদি অংশগ্রহণে অনীহা দেখায়, তবে শুধু জাতীয় ঐকমত্যের কথা বলে হাত গুটিয়ে রাখা যাবে না। কমিশনের উচিত সংলাপ ডেকে চাপ তৈরি করা।”
রাজনৈতিক মহলের প্রতিক্রিয়া
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেন, “জাতীয় ঐকমত্য গড়তে হলে আগে ইসিকে নিরপেক্ষ ভূমিকা নিতে হবে। এখন পর্যন্ত আমরা তেমন কিছু দেখিনি। সরকারপ্রধানের অধীনে থেকে কোনো সংস্কার টেকসই হবে না।”
আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব উল আলম হানিফ বলেন, “সরকার সব সময় অবাধ নির্বাচনের পক্ষে। ইসি চাইলে রাজনৈতিক দলের সঙ্গে বসে ঐকমত্যে পৌঁছাতে পারে। আমরা প্রস্তুত।”
জাতীয় পার্টির মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নু বলেন, “ইসি ইতিবাচক ভূমিকা রাখলে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে আস্থা ফিরবে। ইসির উচিত আগে নিজস্ব ক্ষমতার মধ্যে থাকা সংস্কারগুলো বাস্তবায়নে জোর দেওয়া।”
নির্বাচন কমিশন যখন পরবর্তী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রস্তুতিতে ব্যস্ত, তখন সিইসি’র এই বক্তব্য রাজনৈতিক সংস্কার নিয়ে নতুন করে ভাবার প্রয়োজনীয়তা সামনে আনল। ইসির একক প্রয়াস নয়, বরং রাজনৈতিক দলগুলোর আন্তরিকতা ও জাতীয় সংলাপের মাধ্যমেই নির্বাচন ব্যবস্থা গ্রহণযোগ্যতা পাবে—এটাই এখন সকলের প্রত্যাশা।
অস্ট্রেলিয়ার মতো উন্নত গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের সমর্থনও এ প্রক্রিয়াকে আরো দৃঢ়তা দেবে বলে আশা করা হচ্ছে।
বাংলাবার্তা/এমএইচ