
ছবি: সংগৃহীত
বিশ্বজুড়ে চলমান অর্থনৈতিক, পরিবেশগত এবং সামাজিক নীতির সমালোচনা করে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা এবং নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, বর্তমান সভ্যতা একটি আত্মবিনাশী পথে এগোচ্ছে। তিনি মনে করেন, বিশ্বব্যাপী উৎপাদন ও ভোগের ধারা শুধু বর্জ্য সৃষ্টি করছে, যা ভবিষ্যতের জন্য ভয়ানক বিপদের ইঙ্গিত দিচ্ছে।
বৃহস্পতিবার (২৪ এপ্রিল), বাংলাদেশ সময় দুপুরে কাতার বিশ্ববিদ্যালয়ের বি২৩৯ মিলনায়তনে আয়োজিত 'তিন শূন্যের একটি বিশ্ব নির্মাণ: শূন্য নেট কার্বন নির্গমন, শূন্য সম্পদ মজুদ এবং শূন্য বেকারত্ব' শীর্ষক আন্তর্জাতিক অধিবেশনে তিনি এ মন্তব্য করেন। এই অধিবেশনটি ছিল মূলত ‘থ্রি জিরো ওয়ার্ল্ড’ বা তিন শূন্যের দর্শনের বাস্তবায়ন নিয়ে একটি নীতি-আলোচনা সভা, যেখানে পরিবেশ, সমাজ ও অর্থনীতির মধ্যে ভারসাম্য আনার প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরা হয়।
ড. ইউনূস বলেন, “আমরা এমন এক সভ্যতার মধ্যে রয়েছি, যা নিজেদের অস্তিত্ব নিজেই ধ্বংস করছে। যত বেশি উন্নয়ন হচ্ছে, তত বেশি বর্জ্য তৈরি হচ্ছে। এই প্রবণতা এক সময় মানবজাতিকেই ধ্বংসের মুখে ঠেলে দেবে। উন্নয়ন এখন আর মানুষের কল্যাণে নয়, বরং প্রকৃতি ও সমাজের ক্ষতির বিনিময়ে হচ্ছে।”
তিনি আরও বলেন, “বিশ্বায়ন ও কর্পোরেট-নিয়ন্ত্রিত অর্থনীতি সমাজে অসমতা বাড়িয়ে তুলছে। ধনী আরো ধনী হচ্ছে, গরিব আরো গরিব। এতে সমাজে ক্ষোভ, সহিংসতা ও রাজনৈতিক অস্থিরতা বাড়ছে, যা শেষ পর্যন্ত বিশ্বকে অনিশ্চয়তার দিকে ঠেলে দিচ্ছে।”
ড. ইউনূস তাঁর বিখ্যাত ‘থ্রি জিরো’ তত্ত্ব ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বলেন, “শূন্য কার্বন নিঃসরণ মানে এমন একটি পৃথিবী, যেখানে জীবাশ্ম জ্বালানির ওপর নির্ভরতা থাকবে না। শূন্য সম্পদ মজুদ বলতে বোঝানো হয়েছে, অর্থ ও সম্পদের সুষম বণ্টন, যাতে কেউ অপ্রয়োজনীয় সম্পদের পাহাড় গড়ে না তোলে। আর শূন্য বেকারত্ব মানে প্রত্যেক মানুষ অর্থনৈতিকভাবে সক্রিয় ও আত্মনির্ভর হবে।”
তিনি বলেন, “আমরা যদি এই তিনটি লক্ষ্য অর্জন করতে পারি, তাহলেই একটি টেকসই ও মানবিক সভ্যতার ভিত্তি গড়া সম্ভব।”
অনুষ্ঠান শেষে কাতারের প্রধানমন্ত্রী শেখ মোহাম্মদ বিন আব্দুল রহমান বিন জসিম আল সানির সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক বৈঠকে মিলিত হন ড. ইউনূস। এই বৈঠকে বাংলাদেশ-কাতার পারস্পরিক সহযোগিতা, বিশেষ করে জলবায়ু পরিবর্তন, নবায়নযোগ্য জ্বালানি, এবং তরুণ উদ্যোক্তা উন্নয়ন বিষয়ক বিষয় উঠে আসে।
বৈঠকে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেন, জ্বালানি উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান, জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা ড. খলিলুর রহমান এবং এসডিজি বিষয়ক মুখ্য সমন্বয়ক লামিয়া মোরশেদ উপস্থিত ছিলেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন অধ্যয়ন বিভাগের অধ্যাপক ড. রাশেদা চৌধুরী বলেন, “ড. ইউনূসের বক্তব্য শুধু একটি দর্শন নয়, এটি ভবিষ্যতের জন্য নীতিনির্ধারকদের একটি গাইডলাইন হওয়া উচিত। আমরা যদি আজ সচেতন না হই, তাহলে আগামী প্রজন্মকে একটি বিপর্যস্ত পৃথিবী উপহার দিতে হবে।”
পরিবেশ অধিকারকর্মী সৈয়দ আবুল মোকারেম বলেন, “এখনো যদি আমরা উন্নয়নের নামে বন কাটতে থাকি, নদী দখল করি, কার্বন নিঃসরণ বাড়াই, তাহলে ‘আত্মবিনাশ’ শব্দটিই হবে আমাদের ভবিষ্যতের পরিচয়।”
ড. ইউনূসের এই মন্তব্য কেবল একটি বক্তৃতা নয়—এটি একটি নৈতিক এবং বাস্তব সংকেত যে বর্তমান সভ্যতা পথ হারিয়ে ফেলেছে। উন্নয়ন যদি পরিবেশ, সমাজ ও মানুষের অধিকারকে উপেক্ষা করে এগোয়, তাহলে তা দীর্ঘস্থায়ী হতে পারে না। এখন সময়—একটি মানবিক ও অন্তর্ভুক্তিমূলক সভ্যতা গঠনের জন্য ‘থ্রি জিরো’ দর্শনের মতো বিকল্প পথ খুঁজে নেওয়ার।
বাংলাবার্তা/এমএইচ