
ছবি: সংগৃহীত
বাংলাদেশের সংকটাপন্ন অর্থনীতি আবার ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করেছে, আর এই পুনরুত্থানের প্রধান কৃতিত্ব প্রবাসী বাংলাদেশিদের নিরলস শ্রম, ভালোবাসা ও অর্থনৈতিক অবদানের। এমনই মন্তব্য করেছেন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ও নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস।
বৃহস্পতিবার (২৪ এপ্রিল) কাতারের রাজধানী দোহায় স্থানীয় এক হোটেলে প্রবাসী বাংলাদেশিদের সঙ্গে মতবিনিময়কালে তিনি এই মন্তব্য করেন। এটি ছিল কাতারে তাঁর প্রথম প্রবাসীবান্ধব সভা, যেখানে বিপুলসংখ্যক প্রবাসী বাংলাদেশি উপস্থিত ছিলেন। সভায় ছিল আবেগঘন পরিবেশ, আর প্রতিটি কথায় উঠে এসেছে রাষ্ট্র ও প্রবাসীদের পারস্পরিক দায়িত্ব, সম্মান এবং ভবিষ্যতের অঙ্গীকারের বিষয়।
ড. ইউনূস বলেন, “প্রবাসীরা বাংলাদেশের অর্থনীতির মেরুদণ্ড। আপনারা বৈদেশিক মুদ্রা পাঠিয়ে শুধু দেশের অর্থনীতি বাঁচাননি, বরং দেশের মানুষকে বাঁচিয়েছেন। আমরা আজ যে শক্ত হয়ে দাঁড়াতে পারছি, তার পেছনে মূল চালিকাশক্তি আপনারা। আপনারা সহযোগিতা না করলে আমরা কখনোই এই সংকট কাটিয়ে উঠতে পারতাম না।”
তিনি আরও বলেন, “প্রবাসীরা কখনোই বাংলাদেশের বাইরে নয়। তাঁরা বাংলাদেশে থাকেন না শুধু, কিন্তু তাঁদের হৃদয়ে, কাজে, ত্যাগে বাংলাদেশ প্রতিনিয়ত বাস করে। তাই তাঁদের কখনো বিচ্ছিন্ন ভাবার সুযোগ নেই।”
সভায় উপস্থিত প্রবাসীদের অনেকেই বিমানবন্দরে হয়রানি, কার্গো পরিবহনে ব্যয়বৃদ্ধি, পাসপোর্ট নবায়নে বিলম্ব এবং প্রশাসনিক জটিলতা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। প্রবাসীদের এমন বাস্তব সমস্যাগুলোর জবাবে ড. ইউনূস বলেন, “বিমানবন্দরে আপনাদের জন্য ভিআইপি মর্যাদার সেবা চালু করার পরিকল্পনা নিয়েছি। প্রবাসীরা যেন দেশে এলে স্বস্তিতে নামতে পারেন, দেশে ফিরে যেন তাঁদের সম্মান ও মর্যাদা বুঝতে পারেন—আমাদের নীতিনির্ধারণে সেটি অগ্রাধিকার পাচ্ছে।”
কার্গো পরিবহন ও বিমান ভাড়ার প্রসঙ্গে ড. ইউনূস বলেন, “অনেক ব্যবসায়ী অভিযোগ করেছেন পণ্য পরিবহনের জন্য বিমান ভাড়া অত্যন্ত বেশি, যা রপ্তানিকারকদের জন্য বড় বোঝা। আমরা বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বসহকারে দেখছি। দ্রুত পরিবহন নিশ্চিত করার পাশাপাশি ভাড়া কমানোর পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। শুধু ঢাকা নয়, চট্টগ্রাম ও সিলেট বিমানবন্দর থেকে কীভাবে সহজে পণ্য পরিবহন করা যায়—তা নিয়েও আমরা পরিকল্পনা করছি।”
সভায় ড. ইউনূস পাসপোর্ট, ন্যাশনাল আইডি, জন্মনিবন্ধন ও অন্যান্য প্রবাসীসংশ্লিষ্ট সেবা ডিজিটাল করার উদ্যোগের কথাও জানান। তিনি বলেন, “পাসপোর্টসহ সব ধরনের সেবা অনলাইনে আনার কাজ দ্রুত এগিয়ে চলছে। প্রবাসীরা যেন আর দূতাবাসে ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা না করেন, সেটি নিশ্চিত করতে আমরা প্রযুক্তিনির্ভর সমাধানে এগোচ্ছি।”
তিনি সরকারকে পরামর্শ দিয়ে বলেন, “যেকোনো পরিকল্পনার আগে প্রবাসীদের সঙ্গে পরামর্শ করা উচিত। কারণ তারাই জানেন, কোথায় তাঁদের কষ্ট, কোথায় সেবা প্রয়োজন। প্রবাসীদের পরামর্শকে আমরা রাষ্ট্রীয় নীতির অংশ করব।”
এ সময় তিনি স্মরণ করিয়ে দেন যে, দেশের আর্থিক ব্যবস্থার অনেক অংশে প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স এখনও বড় সহায়ক শক্তি হিসেবে কাজ করছে। তার ভাষায়, “যেখানে বহুজাতিক ঋণদাতা সংস্থাগুলো ঋণ বন্ধ বা শর্তসাপেক্ষ করেছে, সেখানেই প্রবাসীদের রেমিট্যান্সের টাকায় অনেক সামাজিক ও অর্থনৈতিক কর্মসূচি সচল রয়েছে।”
সভায় আরও বক্তব্য দেন পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেন, জ্বালানি উপদেষ্টা ফাওজুল কবির খান, জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা ড. খলিলুর রহমান, প্রধান উপদেষ্টার এসডিজি বিষয়ক মুখ্য সমন্বয়ক লামিয়া মোরশেদ এবং প্রেসসচিব শফিকুল আলম।
কাতারে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত মো. নজরুল ইসলাম বলেন, “প্রবাসীরা শুধু দেশের অর্থনীতিকে সমৃদ্ধ করেন না, বরং দেশের ভাবমূর্তিও বহন করেন। তাই তাঁদের সমস্যা সমাধানে দূতাবাস সবসময় আন্তরিক।”
মতবিনিময় শেষে এক আবেগঘন পরিবেশে প্রবাসীদের তরফ থেকে ড. ইউনূসকে সম্মাননা দেওয়া হয়। তাঁরা বলেন, “দীর্ঘদিন পর আমরা একজন দায়িত্বশীল রাষ্ট্রনায়কের কাছ থেকে এমন আন্তরিকতা দেখলাম। আমরা আশা করি, তাঁর নেতৃত্বে বাংলাদেশ নতুন করে অর্থনৈতিক ও সামাজিক অগ্রগতির পথে এগিয়ে যাবে।”
প্রবাসী সমাজের পক্ষ থেকে এ সময় আরও দাবি জানানো হয়—বিশেষ প্রবাসী কার্ড চালু করা, ব্যাংকিং সুবিধা সহজ করা, প্রবাসী বিনিয়োগে করছাড় দেওয়া এবং প্রবাসীদের সন্তানদের জন্য দেশে উচ্চশিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবা সহজলভ্য করার।
সার্বিকভাবে এই মতবিনিময় সভা কাতারে প্রবাসী বাংলাদেশিদের মধ্যে নতুন আশার সঞ্চার করে। তাঁদের প্রত্যাশা, সরকারের এই মনোযোগ যদি বাস্তবায়নে প্রতিফলিত হয়, তবে আগামীদিনে প্রবাসীদের সম্পর্ক আরও দৃঢ় হবে দেশের সঙ্গে।
ড. ইউনূসের কথায়, “বাংলাদেশের জন্য কাজ করতে হলে দেশের বাইরে থাকা বাংলাদেশিদের সঙ্গে ভালোবাসা ও আস্থার সম্পর্ক গড়ে তুলতে হবে। কারণ তাঁরা দূরে থাকলেও দেশের সবচেয়ে কাছে।”
বাংলাবার্তা/এমএইচ