
ছবি: সংগৃহীত
বাংলাদেশে প্রতিদিনই বাড়ছে খুন, রক্তপাত আর মানবিক সঙ্কটের ঘটনা। মানুষের ব্যক্তিগত, পারিবারিক, রাজনৈতিক ও আর্থিক দ্বন্দ্ব এখন প্রায়শই রক্তাক্ত পরিণতিতে রূপ নিচ্ছে। ২০২৫ সালের মার্চ মাসে দেশে ঘটে গেছে ভয়াবহ মাত্রার হত্যাকাণ্ড—মাত্র ৩১ দিনে খুন হয়েছে ৩১৬ জন। অর্থাৎ গড়ে প্রতিদিনই প্রাণ হারিয়েছেন অন্তত ১০ জন। চলতি এপ্রিল মাসের ২৩ তারিখ পর্যন্তও শতাধিক হত্যাকাণ্ডের মামলা রেকর্ড করা হয়েছে, যা বলছে এই প্রবণতা থেমে নেই—বরং সমাজে একটি স্থায়ী সহিংস সংস্কৃতির দানা বাঁধছে।
সম্প্রতি ঘটে যাওয়া কিছু হত্যাকাণ্ড এর ভয়াবহতা ও নৃশংসতার বহিঃপ্রকাশ ঘটায়। রাজধানীর বনানীতে প্রাইমএশিয়া ইউনিভার্সিটির ছাত্র জাহিদুল ইসলাম পারভেজকে ছুরিকাঘাতে হত্যা করা হয়েছে দুই তরুণীর মধ্যে কথাকাটাকাটির জেরে। মগবাজারে রাজনৈতিক আধিপত্যে এক বিএনপি নেতাকে গুলি করে হত্যা, কিশোরগঞ্জের হাওরে মাছ ধরাকে কেন্দ্র করে ছুরি মেরে হত্যা, গাজীপুরে দুই শিশু সন্তানকে তাদের মা বঁটি দিয়ে কুপিয়ে হত্যা, রাজশাহীতে মেয়েকে উত্ত্যক্ত করার প্রতিবাদে পিতাকে পিটিয়ে হত্যা, কিংবা জমি নিয়ে বিরোধে বৃদ্ধকে পিটিয়ে হত্যা—এই সব ঘটনাই বলছে, বাংলাদেশে এখন মানুষ মরে ‘অকারণে’। পারিবারিক অশান্তি, সামাজিক বিরোধ, রাজনৈতিক প্রতিহিংসা বা কখনো শুধুই মুহূর্তের রাগে ঝরে যাচ্ছে তাজা প্রাণ।
পুলিশ সদর দপ্তরের দেওয়া তথ্যমতে, ২০২৫ সালের মার্চ মাসে দেশের বিভিন্ন থানায় রেকর্ড হওয়া হত্যা মামলার সংখ্যা ৩১৬টি। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি খুন হয়েছে পুলিশের ঢাকা রেঞ্জে—৬৬টি। এরপর চট্টগ্রাম রেঞ্জে ৬৫টি, খুলনা রেঞ্জে ৩৫টি এবং মহানগর এলাকা হিসেবে ঢাকায় ৩৩টি খুন। ফেব্রুয়ারিতে খুন হয় ২৯৪ জন এবং জানুয়ারিতে ৩০০ জন, যা বলে দেয়, এই প্রবণতা রীতিমতো ধারাবাহিক হয়ে দাঁড়িয়েছে।
এই সব হত্যাকাণ্ডের কারণ বিশ্লেষণে উঠে এসেছে নানা সমাজ-রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অনুষঙ্গ। এগুলোর মধ্যে প্রধানত দেখা যায়—
পারিবারিক বিরোধ ও গৃহকলহ
রাজনৈতিক সহিংসতা ও প্রতিপক্ষ দমন
মাদক ব্যবসা ও তার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে সংঘর্ষ
জমি-জমার বিরোধ
প্রেমঘটিত দ্বন্দ্ব, পরকীয়া বা সম্পর্কজনিত টানাপোড়েন
ছিনতাই ও ডাকাতির সময় বাধা দেওয়া
আধিপত্য বিস্তারের লড়াই
শিশুরা খুন হচ্ছে আত্মীয়-পরিজনের হাতে, কখনো বাবা-মা কিংবা চাচার হাতে
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ও সমাজ বিশ্লেষক অধ্যাপক ড. ইফতেখার উদ্দিন চৌধুরী মনে করেন, “সমাজে নৈতিক মূল্যবোধের চূড়ান্ত অবক্ষয়, লোভ, আত্মকেন্দ্রিকতা ও স্বার্থপরতাই এই সহিংসতার মূল চালিকা শক্তি। রাষ্ট্র যদি কঠোরভাবে আইনের প্রয়োগ নিশ্চিত না করে, অপরাধীরা যদি বারবার রাজনৈতিক প্রভাব বা দুর্বল আইনের ফাঁকে বেরিয়ে যেতে পারে, তাহলে সমাজে এধরনের সহিংসতা বাড়তেই থাকবে।”
তিনি আরও বলেন, “তথ্যপ্রযুক্তির অপব্যবহার, বিদেশি সহিংস সংস্কৃতির অনুকরণ ও পর্নোগ্রাফি-সহিংস বিনোদনের প্রভাবও সমাজে সহিংসতার প্রবণতা বাড়াচ্ছে। আবার শিশুদের মানসিক বিকাশেও ঝুঁকি তৈরি করছে।”
পুলিশ সদর দপ্তরের সহকারী মহাপরিদর্শক (মিডিয়া ও পিআর) ইনামুল হক সাগর জানান, প্রতিটি হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় আইনানুগ প্রক্রিয়া অনুসরণ করে মামলা নেওয়া হচ্ছে এবং প্রয়োজনীয় তদন্ত কার্যক্রম চালানো হচ্ছে। তিনি বলেন, “দেশব্যাপী পুলিশ সদস্যরা সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে এসব অপরাধের বিরুদ্ধে কাজ করছে, এবং অপরাধীদের গ্রেপ্তার করে বিচারের আওতায় আনছে।”
তবে ফোর্সের একটি অংশ মনে করছে, এতো সংখ্যক খুন রোধ করতে হলে শুধু পুলিশি অভিযান যথেষ্ট নয়। বিচার ব্যবস্থার জটিলতা, মামলার দীর্ঘসূত্রতা, জামিনের অপব্যবহার ও রাজনৈতিক আশ্রয়-প্রশ্রয়েই অপরাধীরা উৎসাহিত হচ্ছে।
মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাধবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক উমর ফারুক মনে করেন, “দেশে এই মুহূর্তে আইনের শাসন দুর্বল। বিচারপ্রক্রিয়া ধীরগতির, রাজনৈতিক প্রভাব আছে, আবার অনেক ক্ষেত্রেই মামলার চার্জশিটে দুর্বলতা থাকে। ফলে খুন করে পার পেয়ে যাওয়া এখন এক প্রকার সামাজিক চিত্র হয়ে দাঁড়িয়েছে।”
তিনি মনে করেন, সামাজিক পুনর্গঠন, শিক্ষা ব্যবস্থায় মূল্যবোধের চর্চা, ধর্মীয় ও নৈতিক শিক্ষা, এবং প্রশাসনিক স্বচ্ছতা ছাড়া এই সঙ্কট কাটানো অসম্ভব।
এই পরিসংখ্যান আর বিশ্লেষণগুলো আমাদের সামনে যে বাস্তবতা তুলে ধরছে তা অত্যন্ত মর্মান্তিক। সমাজে এমন এক অবস্থা তৈরি হয়েছে যেখানে মানুষ এখন ‘তুচ্ছ’ কারণে ‘খুন’ হতে পারে—একটু শব্দ করলেই, একটু রাগ দেখালেই, কারও প্রেমে বাঁধা দিলেই বা সম্পত্তি নিয়ে প্রতিবাদ করলেই। একসময় সমাজে খুন হতো ‘কারণ’ নিয়ে, এখন খুন হয় ‘উপলক্ষ’ খুঁজে।
এই ভয়াবহতার দায় শুধু অপরাধীদের নয়, বরং রাষ্ট্রের প্রতিটি স্তরে যে উদাসীনতা, রাজনৈতিক দলগুলোর মদত, বিচারহীনতার সংস্কৃতি—সব মিলেই সমাজে এক ‘মৃত্যুর সংস্কৃতি’ তৈরি করেছে। এটি শুধু একটি আইনশৃঙ্খলার সমস্যা নয়, এটি একটি গভীর সামাজিক ও নৈতিক দুর্যোগ।
বাংলাদেশের সমাজ এখন একটি ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছে—যেখানে খুন সাধারণ অপরাধে পরিণত হয়েছে। ‘হত্যা’ যেন এক দুঃসহ স্বাভাবিকতা। এক মাসে তিন শতাধিক মানুষ হত্যার শিকার হওয়ার পরও আমরা যদি না জাগি, যদি আইনকে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত না করতে পারি, যদি স্কুল, পরিবার ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলোতে নৈতিকতা শেখানো না হয়—তাহলে আগামী মাসগুলিতে হয়তো সংখ্যাটা আরও বাড়বে।
প্রশ্ন উঠছে—এ কোন সমাজে বাস করছি আমরা? মৃত্যুকে এত সহজভাবে মেনে নেওয়া কি আমাদের ভবিষ্যতের জন্য অশনী সংকেত নয়?
বাংলাবার্তা/এমএইচ