
ছবি: সংগৃহীত
বিগত এক দশকের বেশি সময় ধরে দেশের শিল্প খাতে গ্যাস সরবরাহ ছিল এক নিরব ব্যথার নাম। উৎপাদন ব্যাহত, বিনিয়োগ স্থবির, কারখানা বন্ধের মতো দৃশ্য যেন দৈনন্দিন চিত্র হয়ে উঠেছিল। এমন অবস্থায় দেশের অর্থনীতিকে ঘুরে দাঁড়াতে এবং শিল্প খাতকে গতি ফেরাতে এক যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত নিয়েছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। শিগগিরই দেশে স্থাপন করা হচ্ছে একটি স্থলভিত্তিক এলএনজি (লিকুইফায়েড ন্যাচারাল গ্যাস) টার্মিনাল। বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম।
এই টার্মিনাল স্থাপন হলে বিদেশ থেকে আমদানি করা এলএনজি-কে সহজেই গ্যাসে রূপান্তর করে দেশের অভ্যন্তরে সরবরাহ করা যাবে, যা দীর্ঘমেয়াদে শিল্প ও জ্বালানি খাতের স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করবে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
বৃহস্পতিবার কাতারের রাজধানী দোহা থেকে সাংবাদিকদের ব্রিফিংয়ে প্রেস সচিব বলেন, “অনেক উদ্যোক্তা অভিযোগ করেছেন, গ্যাস না পাওয়ায় তারা নতুন কারখানা স্থাপন করতে পারছেন না। তাদের সেই সমস্যার স্থায়ী সমাধানে স্থলভিত্তিক এলএনজি টার্মিনাল নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।”
প্রেস সচিব জানান, কাতারে অধ্যাপক ইউনূসের সফরকালে দেশটির জ্বালানি বিষয়ক রাষ্ট্রীয় কোম্পানি QatarEnergy-এর সঙ্গে আলোচনায় এসেছে এই টার্মিনালের সম্ভাব্য বিনিয়োগ ও প্রযুক্তি সহায়তা।
“আমরা চাই, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব এই টার্মিনালের কাজ শুরু হোক। এতে করে দেশে নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস সরবরাহ নিশ্চিত হবে, আর শিল্পায়নে নতুন গতি আসবে,” বলেন তিনি।
ঢাকার আশুলিয়ার গার্মেন্ট মালিক আবদুল হান্নান বলেন, “গ্যাস সংকটেই গত বছর আমার তিনটা ইউনিট বন্ধ হয়ে গেছে। কারখানার লাইন চালু থাকলেও হিটার চলে না। সামান্য গ্যাস পেলেই আমরা রপ্তানি বাড়াতে পারি।”
তিনি বলেন, এলএনজি টার্মিনালের ঘোষণা শুনে আশাবাদী হয়েছেন, তবে দ্রুত বাস্তবায়নের ওপর গুরুত্ব দিতে হবে।
বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশনের সহসভাপতি মোহাম্মদ মনির হোসেন বলেন, “আমরা দীর্ঘদিন ধরে বলছি, গ্যাস সাপ্লাই ছাড়া টেকসই উৎপাদন সম্ভব না। অবশেষে সরকার টার্মিনাল বানানোর কথা বলেছে। আশা করি এটা শুধু কথায় সীমাবদ্ধ থাকবে না।”
প্রেস সচিব শফিকুল আলম বলেন, “এই সফর শুধু এলএনজি নিয়েই নয়, বরং সামগ্রিক অর্থনীতি ও বিনিয়োগ আস্থা বাড়ানোর ক্ষেত্রে বড় ভূমিকা রাখবে।”
তিনি বলেন, কাতারে প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠকে থাকা বিভিন্ন বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশের বাজারে ঢোকার আগ্রহ দেখিয়েছে। তিনি জানান,
“সফরটি এতটাই সফল হয়েছে যে আমি বলব এটি আমাদের ইতিহাসের অন্যতম সেরা কূটনৈতিক অর্জন।”
সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে শফিকুল আলম দাবি করেন, “আগের সরকারের সময় বিদেশি ঋণ ছিল ৩২০ কোটি ডলার। অন্তর্বর্তী সরকার মাত্র ৮ মাসে তা কমিয়ে এনেছে ৬০ কোটি ডলারে।”
তিনি আরও বলেন, “এই ঋণও আমরা কয়েক মাসের মধ্যেই শোধ করে ফেলব। এটি আন্তর্জাতিক মহলে একটি শক্তিশালী বার্তা দেবে যে, বাংলাদেশ এখন ব্যবসার জন্য প্রস্তুত।”
জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ও বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. মেহেদী হাসান বলেন, “বর্তমানে বাংলাদেশে দুটি ভাসমান এলএনজি টার্মিনাল আছে, যা আবহাওয়া ও সমুদ্র পরিস্থিতির ওপর নির্ভরশীল। স্থলভিত্তিক টার্মিনাল হলে সারা বছর নিরবচ্ছিন্ন সরবরাহ নিশ্চিত হবে।”
তিনি সতর্ক করে বলেন, “তবে শুধু ঘোষণায় লাভ নেই, দ্রুত বাস্তবায়ন না হলে গ্যাস সংকট বাড়তেই থাকবে। তাই প্রকল্প বাস্তবায়নে স্বচ্ছতা ও দক্ষতা অপরিহার্য।”
চলতি চার দিনের সফর শেষে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস আজ শুক্রবার দোহা থেকে রওনা হয়েছেন পোপ ফ্রান্সিসের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় যোগ দিতে রোমে। প্রেস সচিব জানান, এই সফরের মাধ্যমেই বিশ্ব রাজনীতিতে বাংলাদেশের সক্রিয় ও সম্মানজনক অবস্থান পুনরুদ্ধারের পথে এক বড় ধাপ অতিক্রান্ত হয়েছে।
বাংলাবার্তা/এমএইচ