
ছবি: সংগৃহীত
বিশ্ব সম্প্রদায়ের এক ব্যতিক্রমী মুহূর্তে অংশগ্রহণ শেষে বাংলাদেশের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস আজ রোববার ঢাকার উদ্দেশে ইতালির রাজধানী রোম ত্যাগ করেছেন। সদ্য প্রয়াত ক্যাথলিক খ্রিষ্টানদের ধর্মীয় নেতা পোপ ফ্রান্সিসের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় যোগদান এবং আন্তর্জাতিক নেতৃবৃন্দের সঙ্গে একাধিক উচ্চপর্যায়ের বৈঠক সম্পন্ন করে তিনি দেশে ফিরছেন।
প্রধান উপদেষ্টার সফরসঙ্গী ও প্রেস সচিব শফিকুল আলম বাসসকে জানান, বাংলাদেশ সময় দুপুর দেড়টার দিকে (স্থানীয় সময় সকাল ৯টা ৩০ মিনিটে) রোমের ফিউমিসিনো আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে অধ্যাপক ইউনূসের ফ্লাইট ঢাকার উদ্দেশে যাত্রা শুরু করে।
পোপের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় বিশ্ব নেতাদের ভিড়ে ইউনূস
গতকাল শনিবার অনুষ্ঠিত হয় পোপ ফ্রান্সিসের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া, যেখানে শতাধিক দেশের রাষ্ট্রপ্রধান, সরকারপ্রধান, ধর্মীয় নেতা এবং বিশিষ্টজনেরা উপস্থিত ছিলেন। গভীর শোক ও শ্রদ্ধার এই আয়োজনে বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করেন অধ্যাপক ইউনূস। তিনি পোপ ফ্রান্সিসের মানবিকতা, শান্তি প্রতিষ্ঠা ও সামাজিক ন্যায়ের পক্ষে অবস্থানের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে শেষ শ্রদ্ধা নিবেদন করেন।
বিশ্বব্যাপী নন্দিত অর্থনীতিবিদ ও সামাজিক ব্যবসার প্রবর্তক হিসেবে ইউনূসের উপস্থিতি আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে ব্যাপক প্রশংসিত হয়। বেশ কয়েকটি আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম তার অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় যোগদানের বিষয়টি বিশেষভাবে উল্লেখ করেছে।
রোম সফরের কূটনৈতিক তাৎপর্য
শুধু অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় যোগদানই নয়, রোম সফরে অধ্যাপক ইউনূস ব্যস্ত সময় কাটান বৈশ্বিক কূটনৈতিক ও অর্থনৈতিক যোগাযোগ সম্প্রসারণে। সফরের সময় তিনি ভ্যাটিকান সিটি ও ইতালীয় কর্তৃপক্ষ ছাড়াও দক্ষিণ আমেরিকার দেশ উরুগুয়ের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এবং ভ্যাটিকানের শীর্ষ ধর্মীয় কর্মকর্তা কার্ডিনাল প্রিফেক্ট কুভাকাডের সঙ্গে বৈঠক করেন।
এই বৈঠকগুলোতে ইউনূস বাংলাদেশে বাণিজ্য ও বিনিয়োগ সম্ভাবনার কথা তুলে ধরেন। তিনি ভ্যাটিকানসহ মার্কোসুর (দক্ষিণ আমেরিকার গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক জোট) সদস্য রাষ্ট্রগুলোর সঙ্গে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সহযোগিতা আরও জোরদারের ওপর জোর দেন। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সক্ষমতা, তরুণ জনগোষ্ঠীর সম্ভাবনা ও সামাজিক ব্যবসার প্রসারের সুযোগ নিয়ে তার উপস্থাপনাকে বেশ ইতিবাচকভাবে গ্রহণ করেন বৈঠকে অংশগ্রহণকারীরা।
বিশেষ করে কাতার থেকে রোমে আসার সময় থেকেই ইউনূস তাঁর কৌশলগত উদ্যোগ নিয়ে সচেষ্ট ছিলেন। কাতারের দোহায়ও তিনি বিভিন্ন অর্থনৈতিক ফোরামে অংশ নিয়েছিলেন, যেখানে যুব বিনিয়োগ, উদ্ভাবনী সামাজিক ব্যবসা এবং টেকসই উন্নয়ন নিয়ে আলোচনা হয়। রোমে এসে তিনি সেই ধারাবাহিকতা বজায় রাখেন।
যুব বিনিয়োগ ও 'তিন শূন্য' দর্শন
রোম সফরের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছিল অধ্যাপক ইউনূস ও উরুগুয়ের মন্ত্রী লুবেটকিনের মধ্যে যুব বিনিয়োগ ও সামাজিক ব্যবসা প্রসারের বিষয়ে গভীর আলোচনা।
তারা উভয়েই ‘তিন শূন্য’ তত্ত্বের প্রতি নতুন করে প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করেন। এই তত্ত্বের মূল লক্ষ্য হলো:
শূন্য বেকারত্ব: তরুণদের জন্য সৃজনশীল কর্মসংস্থান সৃষ্টি করা।
শূন্য সম্পদ মজুদ: সম্পদের ন্যায়সঙ্গত বিতরণ নিশ্চিত করে অর্থনৈতিক বৈষম্য দূর করা।
শূন্য নিট কার্বন নিঃসরণ: পরিবেশবান্ধব ও টেকসই অর্থনৈতিক মডেল গড়ে তোলা।
বিশ্বের বেশ কয়েকটি উন্নয়নশীল ও উন্নত দেশে এই মডেল ইতিমধ্যেই বাস্তবায়নের পথে রয়েছে এবং ইউনূসের নেতৃত্বে বাংলাদেশও এই দিকনির্দেশনায় কাজ করছে। রোমে দেওয়া বক্তব্যে ইউনূস উল্লেখ করেন, “ভবিষ্যতের টেকসই বিশ্ব গঠনে আজকের যুবসমাজকে বিনিয়োগ, উদ্ভাবন এবং দায়িত্বশীল নেতৃত্বের পথে এগিয়ে নিতে হবে। তিন শূন্যের দর্শন এই পরিবর্তনের মূল চাবিকাঠি।”
আন্তর্জাতিক যোগাযোগের নতুন দিগন্ত
প্রধান উপদেষ্টার এই রোম সফরকে বিশ্লেষকরা বাংলাদেশে আন্তর্জাতিক বাণিজ্য ও বিনিয়োগ বাড়ানোর প্রচেষ্টার একটি কৌশলগত পদক্ষেপ হিসেবে দেখছেন।
ঢাকার আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষক ড. সাদিক রহমান বলেন, “অধ্যাপক ইউনূসের মতো আন্তর্জাতিকভাবে গ্রহণযোগ্য ও সম্মানিত ব্যক্তির কূটনৈতিক যোগাযোগ বাংলাদেশকে নতুন নতুন বন্ধু ও বিনিয়োগকারী খুঁজে পেতে সাহায্য করবে। তার সফরের মাধ্যমে শুধু কূটনৈতিক সৌজন্যই নয়, বাস্তবিক অর্থনৈতিক ও সামাজিক সুযোগের দ্বারও খুলবে।”
অপরদিকে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন, আন্তর্জাতিক মঞ্চে ইউনূসের সক্রিয় উপস্থিতি বাংলাদেশের ভাবমূর্তি আরও উজ্জ্বল করবে এবং বিশেষ করে সামাজিক ব্যবসার মতো টেকসই ধারণাগুলিকে বিশ্বব্যাপী আরও দৃঢ় অবস্থান দিতে সাহায্য করবে।
পোপ ফ্রান্সিসের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার মতো এক ঐতিহাসিক ও আবেগঘন মুহূর্তে অংশগ্রহণের পাশাপাশি রোমে বহুপাক্ষিক বৈঠক ও কৌশলগত আলোচনার মধ্য দিয়ে অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস আবারও প্রমাণ করেছেন, মানবিক মূল্যবোধ ও টেকসই উন্নয়নের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ বিশ্বমঞ্চে ইতিবাচক ভূমিকা রাখতে প্রস্তুত।
তার এই সফর শেষ হলেও এর প্রভাব আগামী দিনে বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক কূটনীতিতে সুস্পষ্টভাবে প্রতিফলিত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। ঢাকায় ফিরে তিনি হয়তো দ্রুতই তার সফরের অভিজ্ঞতা ও সম্ভাব্য ফলাফল নিয়ে সরকারের সংশ্লিষ্ট মহলের সঙ্গে পরামর্শ করবেন।
বাংলাবার্তা/এমএইচ