
ছবি: সংগৃহীত
বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস কাতারভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আলজাজিরার সঙ্গে একটি গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষাৎকারে দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি, নির্বাচন, এবং আওয়ামী লীগের নির্বাচনে অংশগ্রহণ নিয়ে বিশদ আলোচনা করেছেন। তার দেওয়া এই সাক্ষাৎকারটি ২৭ এপ্রিল, ২০২৫ তারিখে আলজাজিরার ওয়েবসাইটে প্রকাশিত হয় এবং তা বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট ও আগামী নির্বাচনের ভবিষ্যৎ নিয়ে একটি সুস্পষ্ট দিকনির্দেশনা প্রদান করে।
ড. ইউনূস তার সাক্ষাৎকারে বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসের একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্তের কথা উল্লেখ করেন, যখন ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে ৫ আগস্ট, ২০২৫ তারিখে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশ থেকে পালিয়ে যান। সেই সময়ে বাংলাদেশের জনগণ তাদের প্রতিবাদে সারা দেশজুড়ে উত্তাল হয়ে উঠেছিল। তিনি বলেন, "শেখ হাসিনার পদত্যাগ এবং দেশত্যাগের পর থেকে বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার জনগণের আস্থা অর্জন করতে সক্ষম হয়েছে এবং মানুষ মনে করছে যে, বর্তমান সরকার দেশের জন্য একটি ভালো সমাধান হিসেবে কাজ করছে।"
তিনি আরও বলেন, "বাংলাদেশের মানুষ সরকারকে চলে যেতে বলছে না, বরং তারা একটি সুষ্ঠু, অবাধ এবং নিরপেক্ষ নির্বাচন চায়। মানুষ চায় যে, এই সরকার একটি ভালো নির্বাচন আয়োজন করবে এবং জনগণের পছন্দের প্রতিনিধিরা নির্বাচিত হবে।"
ড. ইউনূস তার সাক্ষাৎকারে বর্তমান সরকারের নির্বাচনী প্রস্তুতি এবং সংস্কারের লক্ষ্যে সরকারের পরিকল্পনা তুলে ধরেন। তিনি বলেন, "আমরা বিগত সরকারের অনিয়ম ও দুর্নীতি দূর করতে এবং দেশের জন্য অর্থবহ সংস্কার চালিয়ে যেতে চাই। আমাদের উদ্দেশ্য হল, অতীতের যে কোনো সময়ের চেয়ে ভালো নির্বাচন আয়োজন করা।"
তিনি নিশ্চিত করেন যে, সরকার নির্বাচনের আয়োজনের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে এবং নির্বাচনী ব্যবস্থায় কোনো ধরনের দুর্নীতি বা অনিয়মের স্থান হবে না। তিনি আরও জানান, "সংস্কারের তালিকা যদি ছোট হয়, তাহলে আমরা ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন আয়োজন করতে পারি, তবে যদি সংস্কারের তালিকা বড় হয়, তাহলে নির্বাচন আগামী বছরের জুনের মধ্যে অনুষ্ঠিত হবে।"
এখন, প্রশ্ন উঠছে, আওয়ামী লীগ কি নির্বাচনে অংশ নেবে? এই প্রশ্নের উত্তরে ড. ইউনূস বলেন, "এই সিদ্ধান্তটি আওয়ামী লীগকেই নিতে হবে। তারা আগে নিজেই সিদ্ধান্ত নেবে যে, তারা নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবে কিনা। এখন পর্যন্ত তারা এ বিষয়ে কোনো ঘোষণা দেয়নি, তাই এখনই কিছু বলা সম্ভব নয়।"
তিনি আরও বলেন, "নির্বাচনের সময় নির্বাচন কমিশন কীভাবে প্রতিক্রিয়া জানাবে এবং অন্য রাজনৈতিক দলগুলোর কী অবস্থান থাকবে, তা অনেক কিছু নির্ধারণ করবে। তবে, এটা নির্বাচন কমিশনের ওপর একেবারেই নির্ভরশীল হবে না। অন্যান্য রাজনৈতিক দলগুলোও হয়তো বলবে যে, এই আইনের অধীনে আওয়ামী লীগ নির্বাচনে অংশ নিতে পারবে না, তবে এই বিষয়ে আলোচনা এখনও চলমান।"
ড. ইউনূস তার সাক্ষাৎকারে বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতির বাইরে কিছু আন্তর্জাতিক সম্পর্ক নিয়েও মন্তব্য করেছেন। তিনি বলেন, "বিমসটেক সম্মেলনের ফাঁকে আমি ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে বৈঠক করেছিলাম। সেখানে শেখ হাসিনাকে ‘চুপ’ রাখতে বলেছিলাম, যাতে রাজনৈতিক পরিস্থিতি আরো অবনতি না হয়। তবে, মোদী সেসময় আমাকে জানিয়েছিলেন, ‘এটি আমার নিয়ন্ত্রণে নেই, কারণ ভারতে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের ব্যবহার প্রতিটি নাগরিকের অধিকার।’ মোদী বলেন, ‘শেখ হাসিনা যদি সামাজিক মাধ্যমে কিছু বলেন, তবে আমি তা নিয়ন্ত্রণ করতে পারব না।’"
এই মন্তব্যটি বাংলাদেশের রাজনৈতিক বাস্তবতায় সামাজিক মাধ্যমের গুরুত্ব এবং তার মাধ্যমে জনমত তৈরির প্রক্রিয়ার ওপর আলো ফেলছে। মোদীর এ কথা প্রমাণ করে যে, আধুনিক বিশ্বে সামাজিক মাধ্যম সরকারের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে, এবং রাজনৈতিক নেতা বা দলের বক্তব্যের উপর তার পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ নেই।
ড. ইউনূস তার সাক্ষাৎকারে বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি এবং নির্বাচনের ভবিষ্যৎ নিয়ে যে মন্তব্য করেছেন, তা দেশটির জনগণের জন্য এক ধরনের আশাবাদ এবং সম্ভাবনার আলোকবর্তিকা হয়ে উঠেছে। তিনি সরকারের দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকে দেশের অবস্থা পরিবর্তন এবং জনগণের জন্য একটি সুষ্ঠু, কার্যকর নির্বাচন নিশ্চিত করতে প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। তার কথায়, "আমরা চাই দেশের জনগণ একটি নিরপেক্ষ ও সুষ্ঠু নির্বাচন উপহার পায় এবং যারা ক্ষমতায় আসবে, তারা জনগণের কাছে প্রকৃত প্রতিনিধিত্ব করবে।"
এদিকে, আওয়ামী লীগ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবে কিনা, তা নিয়ে আলোচনা চলতে থাকলেও, বর্তমান পরিস্থিতি এবং সরকারের ভূমিকা নির্বাচনী পরিবেশে একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলবে। তবুও, ড. ইউনূসের বক্তব্যে এটা পরিষ্কার যে, বাংলাদেশের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে সুষ্ঠু নির্বাচনের ওপর, যেখানে জনগণের ইচ্ছাই চূড়ান্ত বলে প্রতিস্থাপিত হবে।
বাংলাবার্তা/এমএইচ