
ছবি: সংগৃহীত
কাশ্মীরের পেহেলগামে ভয়াবহ বন্দুকধারী হামলায় ২৬ জন নিরীহ পর্যটক নিহত হওয়ার পর ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে উত্তেজনা নতুন করে ভয়াবহ রূপ নিয়েছে। সীমান্তের নিয়ন্ত্রণরেখা (LOC) জুড়ে টানা তৃতীয় রাত ধরে গোলাগুলি অব্যাহত রয়েছে। পাশাপাশি দুই দেশই একে অপরের বিরুদ্ধে পাল্টাপাল্টি দোষারোপ করছে, নিচ্ছে কঠোর কূটনৈতিক ও সামরিক পদক্ষেপ।
বর্তমান প্রেক্ষাপটে পরিস্থিতি দ্রুত নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে পারে বলে বিশেষজ্ঞরা আশঙ্কা করছেন। সবচেয়ে বড় প্রশ্ন এখন—এই সংকটের অভিঘাত কি বাংলাদেশেও পৌঁছাবে? উত্তেজনা আমাদের দেশের জন্য কী ঝুঁকি তৈরি করবে? এবং এখন বাংলাদেশের করণীয়ই বা কী হওয়া উচিত?
বিশ্লেষকদের অভিমত: উত্তেজনার ছায়া বাংলাদেশের ওপর
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের সাবেক শিক্ষক অধ্যাপক ইমতিয়াজ আহমেদ মনে করেন, দক্ষিণ এশিয়ার এই উত্তেজনা কেবল ভারত ও পাকিস্তানেই সীমাবদ্ধ থাকবে না; বাংলাদেশসহ সমগ্র অঞ্চলের ওপর এর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।
তিনি বলেন, 'কাশ্মীরে কোনো ঘটনা ঘটলেই ভারত পাকিস্তানকে দোষারোপ করে, আর বেলুচিস্তানে কিছু ঘটলে পাকিস্তান ভারতকে দায়ী করে। এই পাল্টাপাল্টি দোষারোপের রাজনীতির মধ্যে হাইপ তৈরি হয়, মিডিয়া উত্তেজনা বাড়ায় এবং সরকারগুলো চাপের মধ্যে পড়ে প্রতিশোধমূলক ব্যবস্থা নিতে।'
তিনি সতর্ক করে দেন, সীমান্তবর্তী উত্তেজনা যদি কৌশলগত বা সামরিক অভিযানে রূপ নেয়, তবে পুরো দক্ষিণ এশিয়ার নিরাপত্তা ঝুঁকির মধ্যে পড়বে। তবে তিনি আশা প্রকাশ করেন যে, দু'দেশই পারমাণবিক শক্তিধর হওয়ায় বড় মাপের যুদ্ধের দিকে যাবে না। 'পরিস্থিতি সীমিত আকারের প্রতিশোধমূলক হামলার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে বলে আমি মনে করি,' বলেন অধ্যাপক ইমতিয়াজ।
বাংলাদেশের জন্য তার পরামর্শ—'নীতিনির্ধারকদের উচিত খুব সতর্ক থাকা। কোনো অযাচিত মন্তব্য যাতে সরকার বা বিশিষ্ট ব্যক্তি কেউ না করেন, সেদিকে বিশেষ নজর দিতে হবে।'
ফরহাদ মজহার: ‘উপমহাদেশের উত্তেজনায় বাংলাদেশ সরাসরি আক্রান্ত হবে’
কবি ও চিন্তক ফরহাদ মজহার স্পষ্ট করে বলেন, ভারত-পাকিস্তান উত্তেজনা বাংলাদেশের ওপর সরাসরি প্রভাব ফেলবে। কারণ, উপমহাদেশের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক জটিলতা অভিন্ন ইতিহাস ও ভৌগোলিক সংযোগের কারণে দ্রুত পার্শ্ববর্তী রাষ্ট্রে ছড়িয়ে পড়ে।
তিনি বলেন, 'ভারত ইতিমধ্যে সিন্ধু পানি চুক্তি স্থগিত করেছে, যা আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘনের শামিল। ভারতের ভেতরেও সাম্প্রদায়িক রাজনীতির উচ্চমার্গে উত্তরণ ঘটছে। আগামী বছর বিহার ও পশ্চিমবঙ্গে ক্ষমতা দখলের লক্ষ্যে বিজেপি মুসলিমবিরোধী মনোভাব বাড়াচ্ছে।'
ফরহাদ মজহার মনে করেন, এর নেতিবাচক প্রতিফলন বাংলাদেশেও পড়বে। বিশেষ করে, সদ্য অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের পর বাংলাদেশের প্রতি দিল্লির সন্দেহভরা দৃষ্টিভঙ্গি আরও জটিলতা সৃষ্টি করতে পারে।
তিনি বলেন, 'আমাদের রাজনৈতিক দলগুলোর ভূরাজনৈতিক বোঝাপড়া দুর্বল। এই সংকট মোকাবিলায় তাদের মধ্যে যথেষ্ট দূরদৃষ্টি ও কৌশলগত বিচক্ষণতা নেই।'
তিনি আরো বলেন, 'ভারতের মুসলিম এবং কাশ্মীরিদের প্রতি সংহতি প্রকাশ করে বাংলাদেশকে একটি সুস্পষ্ট, সাহসী অবস্থান নিতে হবে। যাতে ভারতীয় মুসলমান বা কাশ্মীরিদের প্রতি মানবাধিকার সমর্থনের বার্তা যায়, কিন্তু কোনো প্রকার উত্তেজনাকর বক্তব্য না আসে।'
আলতাফ পারভেজ: সামরিক ব্যয় বাড়ার ঝুঁকি এবং সার্কের মৃত্যু
দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া ইতিহাস গবেষক আলতাফ পারভেজ আশঙ্কা প্রকাশ করেন, ভারত-পাকিস্তান উত্তেজনা দক্ষিণ এশিয়ায় সামরিকায়ন বাড়িয়ে দেবে। ফলে দরিদ্র দেশগুলোর উন্নয়ন বাজেট থেকে বরাদ্দ কমে সামরিক খাতে চলে যাবে, যা শেষ পর্যন্ত সাধারণ মানুষের জন্য মারাত্মক হবে।
তিনি বলেন, 'দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে বাণিজ্য বাড়ানোর যে প্রয়াস প্রয়োজন ছিল, তা এখন থেমে যাবে। ভারত-পাকিস্তান সম্পর্কের অবনতির কারণে সার্ক পুনরুজ্জীবনের যে সম্ভাবনা ছিল, তাও বিলীন হয়ে যাবে।'
আলতাফ মনে করেন, বাংলাদেশের জন্য এখন আন্তর্জাতিক কূটনৈতিক অঙ্গনে সক্রিয় হওয়ার সময়। জাতিসংঘ, ওআইসি এবং অন্যান্য ফোরামের মাধ্যমে বাংলাদেশকে বলিষ্ঠ কণ্ঠে বলতে হবে—কাশ্মীর সংকটের শান্তিপূর্ণ সমাধান জরুরি।
'বাংলাদেশের উচিত আন্তর্জাতিক পরিসরে বোঝানো যে, ভারত-পাকিস্তানের উত্তেজনায় বাংলাদেশ, শ্রীলঙ্কা ও মালদ্বীপের নিরাপত্তা হুমকির মুখে পড়ছে,' বলেন তিনি।
অধ্যাপক আমেনা মহসিন: আন্তঃসংযোগের স্বপ্ন ধূলিসাৎ হতে পারে
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের আরেক সাবেক শিক্ষক অধ্যাপক আমেনা মহসিন বলেন, ভারত-পাকিস্তান উত্তেজনার ফলে দক্ষিণ এশিয়ায় আন্তঃসংযোগ এবং অর্থনৈতিক সহযোগিতার স্বপ্ন আরও দুর্বিষহ হয়ে উঠবে।
তিনি বলেন, 'কাশ্মীরে অতীতে পর্যটকদের ওপর এমন হামলা হয়নি। এই হামলার কারণে কাশ্মীরি সাধারণ জনগণের মনস্তাত্ত্বিক পরিবর্তনও ঘটতে পারে।'
বাংলাদেশ সম্পর্কে ভারতের নেতিবাচক প্রচারণার প্রসঙ্গে তিনি বলেন, 'গণঅভ্যুত্থানের পর থেকেই ভারতে বাংলাদেশবিরোধী প্রচারণা বাড়ছে। এখন এই উত্তেজনা তা আরও উসকে দেবে।'
তিনি সতর্ক করে দেন, এই পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের উচিত বহুমুখী কূটনৈতিক প্রস্তুতি নেওয়া এবং আন্তঃরাষ্ট্রীয় সহনশীলতা বজায় রাখার জন্য সর্বোচ্চ প্রচেষ্টা চালানো। 'রাষ্ট্রীয় স্তর থেকে জনসাধারণ পর্যন্ত সজাগ ও সংবেদনশীল থাকা এখন সময়ের দাবি,' বলেন তিনি।
বিশেষজ্ঞদের সারাংশ: বাংলাদেশকে যা করতে হবে
১. সতর্ক কূটনৈতিক ভাষা: সরকারের উচিৎ কোনো উস্কানিমূলক মন্তব্য না করে বিবেচনাপ্রসূত ও ভারসাম্যপূর্ণ বার্তা দেওয়া।
২. আন্তর্জাতিক উদ্যোগ: জাতিসংঘ, ওআইসি-সহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ফোরামে সক্রিয় ভূমিকা রাখা।
৩. সমাজিক সহনশীলতা রক্ষা: অভ্যন্তরীণভাবে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখা।
৪. সামরিক ব্যয় নিয়ন্ত্রণ: অপ্রয়োজনে সামরিক ব্যয় না বাড়ানো এবং সামাজিক খাতে বিনিয়োগ বজায় রাখা।
৫. গণসচেতনতা: প্রচারমাধ্যমে দায়িত্বশীলতা নিশ্চিত করা এবং বিভ্রান্তিমূলক প্রচারণা এড়িয়ে চলা।
বিশেষজ্ঞদের মতে, বাংলাদেশ এখন এমন এক ক্রান্তিকালে দাঁড়িয়ে, যেখানে একদিকে উচিত মানবিক দায়িত্ব পালনের মাধ্যমে প্রতিবেশী জনগণের প্রতি সহমর্মিতা জানানো, আবার অন্যদিকে নিজেদের ভেতর স্থিতিশীলতা, নিরাপত্তা ও কৌশলগত স্বার্থ অক্ষুণ্ণ রাখা। ভারত-পাকিস্তান উত্তেজনা তাই বাংলাদেশের জন্য একটি গভীর কূটনৈতিক ও কৌশলগত পরীক্ষা হয়ে উঠেছে।
বাংলাবার্তা/এমএইচ