
ছবি: সংগৃহীত
সরকার প্রশাসনের শৃঙ্খলা পুনঃস্থাপন এবং কর্মকর্তা-কর্মচারীদের অরাজকতা রোধে কঠোর আইন সংশোধনের উদ্যোগ নিয়েছে। সম্প্রতি, জনগণের আস্থার প্রতি সরকারী কর্মচারীদের দায়বদ্ধতা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় ২০১৮ সালের সরকারি চাকরি আইন সংশোধন করার প্রক্রিয়া শুরু করেছে। যদিও এক সময় 'সরকারি কর্মচারী (বিশেষ বিধান) অধ্যাদেশ, ১৯৭৯' পুনরায় কার্যকর করার চিন্তা ছিল, তবে বর্তমান পরিস্থিতিতে তার পরিবর্তে সংশোধিত সরকারি চাকরি আইনটি বেশি কার্যকরী মনে হচ্ছে।
সরকারি কর্মচারীদের কার্যক্রমে গত বছরের আগস্ট থেকে বিশৃঙ্খলা বেড়ে যাওয়ার পর প্রশাসনে অস্থিরতা সৃষ্টি হয়, যা দেশের প্রশাসনিক কাঠামোকে হুমকির মুখে ফেলেছিল। প্রশাসনের বিভিন্ন স্তরের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা অযথা দাবি তুলে আন্দোলনে লিপ্ত হন, যা রাষ্ট্রীয় কার্যক্রমে জটিলতা তৈরি করে। এতে সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হয় এবং প্রশাসনিক কাজকর্ম ব্যাহত হয়।
এ পরিস্থিতি মোকাবিলায়, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় শৃঙ্খলা রক্ষায় এবং অরাজকতার বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ নেয়ার জন্য সংশোধিত আইন প্রণয়ন করছে। আইনটির মধ্যে এমন বিধান রাখা হয়েছে, যার মাধ্যমে কর্মচারীদের বিরুদ্ধে দ্রুত শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা সম্ভব হবে। কর্মচারী যদি সহকর্মীদের মধ্যে অশান্তি সৃষ্টি করে, কাজে অনুপস্থিত থাকে বা কর্তব্য পালনে অবজ্ঞা করে, তাহলে তার বিরুদ্ধে পদাবনতি, বরখাস্ত কিংবা বেতন কমানোর মতো শাস্তি কার্যকর করা যেতে পারে।
সাবেক সচিব এ কে এম আবদুল আউয়াল মজুমদার বলেন, যদি ১৯৭৯ সালের বিশেষ বিধানের আলোকে সরকারি চাকরি আইন সংশোধন করা হয়, তবে সেটি দরকার আছে। কারণ আমাদের মতো দেশে আমরা কোনো আইন, নিয়ম-কানুন মানতে চাই না। নিজের স্বার্থ ছাড়া কিছু বুঝি না। নিজেরটা পাওয়ার জন্য আমরা যত রকমের আউট অব দ্য ওয়ে যাওয়ার চেষ্টা করি। সেজন্য এ রকম কড়াকড়ি দরকার আছে।"
জনপ্রশাসন বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. মো. মুনির বলেন, "এ ধরনের কঠোর আইন প্রয়োগের ফলে প্রশাসনে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা সম্ভব হবে, তবে এর প্রয়োগ সঠিকভাবে নিশ্চিত করতে হবে। সরকারকে অবশ্যই খেয়াল রাখতে হবে, যাতে এই আইন কোনো ধরনের রাজনৈতিক উদ্দেশ্য বা প্রশাসনিক দুর্ব্যবহার করতে না পারে।"
সাবেক প্রাথমিক ও গণশিক্ষা সচিব সেলিম হাসান বলেন,
"আইন প্রয়োগ মানেই শাস্তি দেওয়া নয়, বরং এর মূল উদ্দেশ্য হলো বার্তা দেওয়া যে, কেউ আইন ভাঙলে তার বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নেওয়া হবে। আমাদের উচিত প্রশাসনের সংস্কৃতি বদলানো এবং আইনের প্রতি শ্রদ্ধা বাড়ানো।"
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন সাবেক উপসচিব বলেন, "আমরা দেখেছি গত বছর প্রশাসনে কী ধরনের বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয়েছে। কর্মকর্তারা একে অপরের বিরুদ্ধে অভিযোগ তুলেছেন, মিছিল করেছে এবং সচিবালয় পর্যন্ত অবরুদ্ধ করা হয়েছে। এসব ঘটনা শৃঙ্খলা ভঙ্গের মূল উদাহরণ। কঠোর আইন প্রয়োগের মাধ্যমে এই ধরণের কর্মকাণ্ড বন্ধ করা সম্ভব হবে।"
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা বলেন, "এখনো পর্যন্ত আমরা যতগুলো প্রচেষ্টা নিয়েছি, তার মধ্যে অনেকটা সময়ক্ষেপণ হচ্ছে, বিশেষ করে অভিযোগের প্রক্রিয়া দীর্ঘ হওয়ায়। তাই এই আইন সংশোধন এবং দ্রুত শাস্তির বিধান কার্যকর করতে পারলে প্রশাসনিক কার্যক্রম অনেক দ্রুত ও ফলপ্রসূ হবে।"
সামাজিক মনোবিদ ড. নাজমুল হোসেন বলেন, "অফিসিয়াল শৃঙ্খলা বজায় রাখতে এই ধরনের আইন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তবে এটি যদি অত্যাধিক কঠোর হয়ে যায়, তাহলে কর্মীদের মধ্যে আতঙ্ক সৃষ্টি হতে পারে এবং তা কর্মক্ষমতা হ্রাস করতে পারে। তাই প্রশাসনকে এই আইন প্রয়োগে সংবেদনশীল হতে হবে।"
এ উদ্যোগের অন্যতম লক্ষ্য হলো কর্মচারীদের শৃঙ্খলাবোধ জাগ্রত করা এবং দ্রুত বিচার প্রক্রিয়া নিশ্চিত করা। তবে, আইন বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করে বলেছেন যে, এর প্রয়োগে যেন কোনোভাবে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য পূরণের অপব্যবহার না হয় এবং নিশ্চিত করা উচিত যে, এই সংশোধন শুধু প্রশাসনিক শৃঙ্খলার উন্নতির জন্যই হবে, ব্যক্তিগত উদ্দেশ্য অথবা রাজনৈতিক চাপের কারণে নয়।
এ বিষয়ে সাবেক প্রশাসনিক কর্মকর্তারা বলেছেন যে, এরকম কঠোর বিধান প্রণয়ন জরুরি, কারণ দেশে আইন অনুসরণ করার সংস্কৃতি অনেক সময় দুর্বল হয়ে পড়ে এবং এমন কঠোর আইন প্রয়োগই শুধু প্রশাসনিক সুশাসন নিশ্চিত করতে সক্ষম হবে।
তবে, কিছু বিশেষজ্ঞ মনে করেন যে, শুধুমাত্র শাস্তি বা কঠোর আইন প্রয়োগই সমস্যার সমাধান নয়, বরং প্রশাসনের সংস্কৃতি ও কর্মচারীদের মধ্যে আইনের প্রতি শ্রদ্ধা জাগানোই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।
বাংলাবার্তা/এমএইচ