
ছবি: সংগৃহীত
রাখাইন রাজ্যে মানবিক সহায়তা পৌঁছাতে বাংলাদেশের ভূখণ্ড ব্যবহারের অনুমতি চেয়েছে জাতিসংঘ। মানবিক বিপর্যয় এড়াতে বাংলাদেশ নীতিগতভাবে এই করিডোর ব্যবহারে সম্মতি দিয়েছে। তবে এ উদ্যোগ বাংলাদেশের জন্য নিরাপত্তার নানা নতুন চ্যালেঞ্জও বয়ে আনতে পারে বলে সতর্ক করেছেন বিশেষজ্ঞরা।
রবিবার বিকেলে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে আয়োজিত এক ব্রিফিংয়ে পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেন জানান, "নীতিগতভাবে আমরা রাখাইন রাজ্যে মানবিক করিডোরের ব্যাপারে সম্মত হয়েছি। এটি হবে কেবল মানবিক সহায়তা সরবরাহের পথ। তবে আমাদের কিছু নির্দিষ্ট শর্ত রয়েছে। সেগুলো পালিত হলেই আমরা জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে এই করিডোর ব্যবহারে সহযোগিতা করবো।"
তিনি আরও বলেন, "মানবিক সহায়তার প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য হলেও আমাদের জাতীয় নিরাপত্তার বিষয়টি সর্বাধিক গুরুত্ব পাচ্ছে। তাই শর্ত ছাড়া করিডোর চালু হবে না।"
রাখাইনে মানবিক বিপর্যয়ের শঙ্কা
জাতিসংঘ জানিয়েছে, রাখাইনে বর্তমানে ভয়াবহ মানবিক সংকট দেখা দিয়েছে। স্থানীয় অর্থনৈতিক ব্যবস্থা সম্পূর্ণরূপে ভেঙে পড়েছে। সীমান্ত বন্ধ হয়ে যাওয়ায় খাদ্য, ওষুধ, প্রয়োজনীয় পণ্য প্রবেশ বন্ধ। ভেঙে পড়েছে জরুরি সেবা, সামাজিক সুরক্ষা ব্যবস্থাও। জাতিসংঘের প্রতিবেদন অনুসারে, আগামী কয়েক মাসের মধ্যেই রাখাইনে দুর্ভিক্ষ দেখা দিতে পারে।
জাতিসংঘের বার্তা অনুযায়ী, যদি দ্রুত মানবিক সহায়তা না পৌঁছায়, তবে শুধু রোহিঙ্গা নয়, রাখাইনের অন্যান্য জাতিগোষ্ঠীও বাংলাদেশ সীমান্তে ঢুকে পড়তে পারে। এটি নতুন করে বড় আকারের শরণার্থী সংকট তৈরি করতে পারে, যা বাংলাদেশের জন্য আরও বড় বোঝা হয়ে দাঁড়াবে।
মানবিক করিডোরের নিরাপত্তা ঝুঁকি
নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা মনে করছেন, বিশ্বের ইতিহাসে মানবিক করিডোর কখনও শতভাগ নিরাপদ ছিল না। মানবিক করিডোরের আড়ালে অপরাধী গোষ্ঠী, বিদ্রোহী বাহিনী, মানবপাচারকারী এবং মাদক চোরাচালানকারীরা প্রায়শই সুবিধা নেয়। মধ্যপ্রাচ্য বা আফ্রিকার যুদ্ধক্ষেত্রের অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে, মানবিক করিডোরগুলো ব্যবহার করে অস্ত্র পাচার, সন্ত্রাসী অনুপ্রবেশ এবং মাদক ব্যবসার মতো অপরাধ সংঘটিত হয়েছে।
ঢাকার নিরাপত্তা বিশ্লেষক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, "রাখাইনের মানবিক করিডোর ব্যবহারে বাংলাদেশকে অতি সতর্ক থাকতে হবে। বিশেষ করে মাদক, অস্ত্র এবং মানবপাচারের ঝুঁকি এখানে প্রকট। রাখাইন অঞ্চল ঐতিহাসিকভাবেই অপরাধমূলক কার্যক্রমের জন্য কুখ্যাত।"
আরেক নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ কর্নেল (অব.) শাহাবুদ্দিন খান বলেন, "মিয়ানমারের জান্তা সরকার আরাকান আর্মিকে কোণঠাসা করতে সব ধরনের সরবরাহ বন্ধ করে দিয়েছে। এখন যে মানবিক সহায়তা বাংলাদেশ হয়ে রাখাইনে যাবে, তার একটি বড় অংশ যদি আরাকান আর্মির হাতে চলে যায়, তাহলে তা আরও বড় নিরাপত্তা হুমকিতে রূপ নিতে পারে।"
শর্ত মেনে করিডোর চালু
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক সিনিয়র কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, করিডোর ব্যবহারে বাংলাদেশ কিছু কঠোর শর্ত আরোপ করেছে। এর মধ্যে রয়েছে:
শুধুমাত্র ত্রাণ ও মানবিক সহায়তা পরিবহন করা যাবে।
কোনো সামরিক উপাদান পরিবহন করা যাবে না।
মানবিক সহায়তা বিতরণে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষক থাকতে হবে।
করিডোর দিয়ে আগত ব্যক্তিদের নিবিড় তল্লাশি ও নজরদারির ব্যবস্থা থাকবে।
তিনি আরও জানান, জাতিসংঘের সাথে এসব শর্ত নিয়ে আলোচনা চলছে। একইসঙ্গে রাখাইনে যেসব গোষ্ঠী নিয়ন্ত্রণে রয়েছে, তাদের সঙ্গে সুনির্দিষ্ট চুক্তি ছাড়া করিডোর ব্যবহার করা হবে না।
আর্থ-সামাজিক বিপর্যয় এবং রাখাইনের রাজনৈতিক অস্থিরতা
জাতিসংঘের ইউএনডিপি গত অক্টোবরে প্রকাশিত এক বিশ্লেষণে জানায়, রাখাইনের অর্থনৈতিক কার্যক্রম প্রায় সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে গেছে। যুদ্ধের কারণে কৃষি উৎপাদন ব্যাপকভাবে হ্রাস পেয়েছে। বাজার ব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে। ভয়াবহ মূল্যস্ফীতি দেখা দিয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে দুর্ভিক্ষ এবং ব্যাপক জনস্রোত তৈরি হওয়ার শঙ্কা তৈরি হয়েছে।
জাতিসংঘের বাংলাদেশ কার্যালয়ের এক জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা বলেন, "আমরা আশঙ্কা করছি, রাখাইনে দুর্ভিক্ষ দেখা দিলে শুধু সীমান্তবর্তী রোহিঙ্গা নয়, রাখাইনের অন্যান্য জাতিগোষ্ঠীও বাংলাদেশে ঢোকার চেষ্টা করবে। তখন পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে পারে।"
আন্তর্জাতিক পরামর্শ ও সমন্বয়ের প্রয়োজন
জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস সম্প্রতি ঢাকা সফরে এসে বলেন, রাখাইনের সংঘাত নিরসন এবং মানবিক বিপর্যয় মোকাবিলায় আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সম্মিলিত প্রচেষ্টা দরকার।
তিনি বলেন, "শুধু বাংলাদেশ নয়, মিয়ানমারের সব প্রতিবেশী দেশকে সংঘাত নিরসনে চাপ তৈরি করতে হবে। প্রথমে সহিংসতা বন্ধ করতে হবে, তারপর সংলাপের মাধ্যমে একটি গ্রহণযোগ্য সমাধান খুঁজে বের করতে হবে।"
তিনি আরও যোগ করেন, "মানবিক সহায়তা প্রবাহ বৃদ্ধি করতে হবে, যেন রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবর্তনের জন্য অনুকূল পরিবেশ তৈরি হয়।"
করিডোর বাস্তবায়নের চ্যালেঞ্জ
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মানবিক করিডোরের মাধ্যমে ত্রাণ সহায়তা পাঠানো নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয় উদ্যোগ। তবে বাংলাদেশকে এমনভাবে করিডোর পরিচালনা করতে হবে যাতে এর মাধ্যমে কোনোভাবেই নিরাপত্তা বিঘ্নিত না হয়। করিডোরের প্রতিটি ধাপ মনিটরিং ও তদারকি করতে হবে। মাদক, অস্ত্র এবং মানবপাচার রোধে কড়া নজরদারি প্রয়োজন।
একজন সীমান্ত নিরাপত্তা বিশ্লেষক বলেন, "কাজটা সহজ নয়। কারণ রাখাইনে কোনো স্বীকৃত প্রশাসন নেই। ফলে যারা ত্রাণ বিতরণের দায়িত্ব নেবে, তারা যদি সশস্ত্র গোষ্ঠীর সদস্য হয়, তাহলে করিডোর নিরাপত্তাহীনতার ফাঁদে পরিণত হতে পারে।"
বাংলাবার্তা/এমএইচ