
ছবি: সংগৃহীত
বাংলাদেশের ইতিহাসের আরেকটি গর্বিত অধ্যায় রচনা করে সোমবার দিবাগত রাত ২টা ২০ মিনিটে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে সৌদি আরবের জেদ্দার উদ্দেশে যাত্রা করেছে প্রথম হজ ফ্লাইট (এসভি-৩৮০৩)। প্রথম এই ফ্লাইটে ৩৯৮ জন হজযাত্রী ছিলেন। বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষ সূত্রে জানা গেছে, যাত্রীদের নিরাপদ, নির্বিঘ্ন এবং সুষ্ঠু যাত্রা নিশ্চিত করতে সর্বোচ্চ প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে।
প্রথম ফ্লাইট ছাড়ার আগে সোমবার সন্ধ্যায় রাজধানীর আশকোনা হজক্যাম্পে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে ‘হজ ফ্লাইট ২০২৫’-এর আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন ধর্ম উপদেষ্টা ড. আ ফ ম খালিদ হোসেন। উদ্বোধনী বক্তব্যে তিনি বলেন, "হজের এই পবিত্র সফর আমাদের জন্য যেমন সৌভাগ্যের, তেমনি দেশের সম্মানেরও বিষয়। তাই প্রতিটি হজযাত্রীকে সৌদি আরবে অবস্থানকালে সে দেশের আইন-কানুন মেনে চলতে হবে এবং কোনোভাবেই এমন কোনো কাজ করা যাবে না যাতে বাংলাদেশের সম্মান ক্ষুণ্ন হয়।"
তিনি আরও বলেন, “সরকার হজ ব্যবস্থাপনায় স্বচ্ছতা ও গতিশীলতা আনার জন্য বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়েছে। আপনাদের সহযোগিতাই এই প্রয়াসকে সফল করবে।”
উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে হজ অফিসার, প্রশাসনিক কর্মকর্তা, বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধি এবং সংশ্লিষ্ট সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর কর্মকর্তারাও উপস্থিত ছিলেন। ধর্ম উপদেষ্টার আহ্বানে হজযাত্রীদের মধ্যে দায়িত্বশীল আচরণের প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করা হয়।
সরকারি তথ্য অনুযায়ী, হজ কার্যক্রমের প্রথম দিনে মোট ১০টি ফ্লাইটে চার হাজার ১৮০ জন হজযাত্রী সৌদি আরবের উদ্দেশে রওনা দেবেন। এই ১০টি ফ্লাইটের মধ্যে আটটি ফ্লাইটের গন্তব্য জেদ্দার কিং আবদুল আজিজ আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর এবং দুটি ফ্লাইটের গন্তব্য মদিনার প্রিন্স মুহাম্মদ বিন আব্দুল আজিজ আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর।
বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, যাত্রীদের ইমিগ্রেশন, স্বাস্থ্য পরীক্ষা, লাগেজ ব্যবস্থাপনা এবং সৌদি গন্তব্যে পৌঁছানোর আগে সব ধাপ সুষ্ঠুভাবে সমাপ্ত করার জন্য বিশেষ ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। এ বছর হজযাত্রীদের জন্য ‘রোড টু মক্কা’ নামের বিশেষ ইমিগ্রেশন সুবিধাও চালু রয়েছে, যার ফলে বাংলাদেশে থেকেই সৌদি ইমিগ্রেশন সম্পন্ন করা সম্ভব হচ্ছে।
চলতি বছর বাংলাদেশ থেকে মোট ৮৭ হাজার ১০০ জন হজযাত্রী সৌদি আরব যাবেন। এদের মধ্যে ৫ হাজার ২০০ জন সরকারি ব্যবস্থাপনায় এবং ৮১ হাজার ৯০০ জন বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় হজে অংশ নেবেন। এ বিশাল সংখ্যক যাত্রী পরিবহনের জন্য তিনটি এয়ারলাইন্সের মাধ্যমে ২৩২টি প্রাক-হজ ফ্লাইট পরিচালিত হবে।
-
বাংলাদেশ বিমানের ১১৮টি ফ্লাইটে ৪৪ হাজার ৩০৭ জন হজযাত্রী
-
সাউদিয়ার ৮০টি ফ্লাইটে ৩২ হাজার ৭৪০ জন হজযাত্রী
-
ফ্লাইনাসের ৩৪টি ফ্লাইটে ১৩ হাজার ৬৫ জন হজযাত্রী
এই বিশাল ব্যবস্থাপনা সম্পর্কে ধর্ম মন্ত্রণালয়ের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, "এত বড় সংখ্যক মানুষকে সুষ্ঠুভাবে সৌদি আরবে পাঠানো এবং ফেরত আনার জন্য সরকার, বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষ, এবং সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলো দিনরাত পরিশ্রম করছে।"
প্রাক-হজ ফ্লাইট চলবে আগামী ৩১ মে পর্যন্ত। এরপর হজের আনুষ্ঠানিকতা শেষে ১০ জুন থেকে ফিরতি ফ্লাইট শুরু হবে। চাঁদ দেখা সাপেক্ষে, ৫ জুন হজের মূল আনুষ্ঠানিকতা অনুষ্ঠিত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। অর্থাৎ, আরাফার দিন এবং ঈদের দিন নির্ধারিত হবে সৌদি আরবে চাঁদ দেখার ওপর ভিত্তি করে।
বাংলাদেশে সৌদি দূতাবাস এবং হজ মিশন-২০২৫ এর পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, হজের সময়কালীন সেবা কার্যক্রম, ওমরাহ পারমিট ইস্যু, মিনায় থাকা-খাওয়া এবং আরাফা-মুজদালিফায় যাতায়াত ব্যবস্থাপনা নিয়ে ব্যাপক প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে।
হজ কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, সৌদি আরবে পৌঁছে যাত্রীরা যেন ইহরাম পরিধান, হজের ফরজ ও ওয়াজিব আদায়, চলাফেরার নিয়ম-কানুন এবং সৌদি সরকারের আরোপিত আইন সম্পর্কে সচেতন থাকেন। বিশেষ করে, সৌদি আরবে ওমরাহ পারমিট, মিনায় অবস্থান, আরাফার খুতবা শোনা ইত্যাদি ক্ষেত্রে যে শৃঙ্খলা মেনে চলার নির্দেশ রয়েছে, তা অক্ষরে অক্ষরে পালনের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
একজন হজ মিশনের কর্মকর্তা বলেন, “হজ শুধুই একটি ধর্মীয় আনুষ্ঠানিকতা নয়, এটি বিশ্বের মুসলিম জাতির সম্মিলিত পরিচয়ের প্রতিফলন। তাই প্রত্যেক হজযাত্রীর দায়িত্ব রয়েছে ব্যক্তিগতভাবে আচরণে শালীনতা বজায় রাখা এবং বাংলাদেশের সম্মান অক্ষুণ্ন রাখা।”
পূর্ববর্তী বছরগুলোতে হজ ব্যবস্থাপনায় কিছু অভিযোগ উঠেছিল - যেমন ফ্লাইট বিলম্ব, লাগেজ হারানো, হজ ক্যাম্পে অব্যবস্থাপনা ইত্যাদি। তাই এ বছর এই বিষয়গুলো কাটিয়ে ওঠার জন্য বিশেষ মনিটরিং টিম গঠন করা হয়েছে। হজযাত্রীদের জরুরি সহায়তার জন্য হটলাইন নম্বর চালু রাখা হয়েছে এবং অনলাইন পোর্টালে প্রতিনিয়ত আপডেট দেওয়া হচ্ছে।
বাংলাদেশের হজ মিশন এবং সরকার যৌথভাবে আশা প্রকাশ করেছে, এবারের হজ কার্যক্রম অতীতের যেকোনো বছরের চেয়ে সুশৃঙ্খল এবং সফল হবে। হজযাত্রীরা যেন শান্তিপূর্ণভাবে তাদের ইবাদত সম্পন্ন করে সুস্থভাবে দেশে ফিরতে পারেন, সেই লক্ষ্যেই সব ধরনের প্রস্তুতি সম্পন্ন করা হয়েছে।
একজন হজযাত্রী আশকোনা হজক্যাম্পে বলেন, "আমরা খুবই আনন্দিত এবং কৃতজ্ঞ যে, বাংলাদেশ সরকার এত সুন্দর ব্যবস্থাপনা করেছে। এখন আমাদের দায়িত্ব সতর্ক থাকা এবং মহান আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য সব কাজ করা।"
বাংলাবার্তা/এমএইচ