
ছবি: সংগৃহীত
তিন দিনব্যাপী পুলিশ সপ্তাহ ২০২৫ আজ সোমবার থেকে শুরু হয়েছে। এই সপ্তাহটি বরাবরই পুলিশ বাহিনীর কর্মকাণ্ড মূল্যায়নের বড় একটি উপলক্ষ হলেও বাস্তবে এটি এখন মূলত পদক বিতরণের আনুষ্ঠানিকতায় সীমিত হয়ে পড়েছে। এ বছরের পদক তালিকাও পুরনো সমালোচিত রীতির ধারাবাহিকতা বহন করছে — এমনটাই মনে করছেন পুলিশের অনেক সদস্য, বিশ্লেষক ও সাধারণ জনতা।
পদক বিতরণ ঘিরে সমালোচনা
এ বছর ৬২ জন পুলিশ সদস্যকে বাংলাদেশ পুলিশ মেডেল (বিপিএম) ও প্রেসিডেন্ট পুলিশ মেডেল (পিপিএম) দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু পদক ঘোষণার আগেই বিতর্ক দানা বাঁধে। অভিযোগ উঠেছে— পদক প্রদানের ক্ষেত্রে ‘পছন্দের’ আধিপত্য, রাজনৈতিক আনুগত্য এবং যোগ্যতার চেয়ে প্রশাসনিক সুবিধা পাওয়া কর্মকর্তাদের প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে।
বিভিন্ন সূত্র জানিয়েছে, গত বছর ছাত্র-জনতার আন্দোলনকালে যারা দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে আহত বা নিহত হয়েছেন, তাদের অনেকেই এবারও পদকের বিবেচনায় আসেননি। অথচ অনেকে, যারা আন্দোলনের সময় দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হয়েছেন বা ভয় পেয়ে দায়িত্বস্থল এড়িয়ে গেছেন, তারাও পদক পেয়েছেন। বিশেষ করে, যারা ২০২৩ সালের ৬-৭ আগস্ট ছাত্র বিক্ষোভের সময় রাজারবাগ পুলিশ লাইনে গমন করেননি, তাদের কয়েকজনকেও পুরস্কৃত করা হয়েছে। এমনকি একজন কর্মকর্তা, যিনি ওই সময় রাজারবাগ থেকে পালিয়ে যান, তাকেও পদকের তালিকায় রাখা হয়েছে।
ভেতর থেকেই ক্ষোভ
পুলিশের অনেক সদস্য এ সিদ্ধান্তে প্রকাশ্যে না হলেও ভেতরে ক্ষুব্ধ। একাধিক পুলিশ সদস্য বলেন, “অপারেশনে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে মাঠে থাকা সদস্যরা আজও অবহেলিত থেকে গেল। অথচ পদক পেয়ে যাচ্ছে তারা, যারা অপমানিত হয়েছে জনসমাবেশে, ব্যর্থতায় সরিয়ে দেওয়া হয়েছে কিংবা রাজনৈতিক সুবিধাভোগী হিসেবে পরিচিত।”
পদক প্রদানের পেছনের ইতিহাস
বাংলাদেশ পুলিশে বিপিএম ও পিপিএম পদক চালু হয়েছিল ১৯৩২ সালে ব্রিটিশ আমলে। দীর্ঘ সময় এসব পদক মূলত মাঠ পর্যায়ের সাহসী ও ব্যতিক্রমী কাজের স্বীকৃতি ছিল। কিন্তু ২০১০ সালের পর থেকে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের মধ্যে ‘স্বীকৃতি বণ্টনের’ একটি রীতি গড়ে ওঠে। অনেক সময় সাব-অর্ডিনেট অফিসারদের কাজের কৃতিত্বও ঊর্ধ্বতন অফিসাররা নিজেদের নামে লিখিয়ে নিয়ে পদক পেয়ে যান।
বিশেষজ্ঞদের মতে, আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে এই রীতি আরও প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পায়। বিরোধী দল দমনে ভূমিকা রাখাসহ রাজনৈতিক আনুগত্য প্রদর্শনের ‘পুরস্কার’ হিসেবেও অনেক পদক দেওয়া হয়। উল্লেখ্য, বিএনপির সিনিয়র নেতা জয়নুল আবদিন ফারুকের ওপর হামলার ঘটনায় দায়ী মোহাম্মদ হারুন অর রশীদকেও এক সময় বিপিএম পদক দেওয়া হয়েছিল।
পদক পাওয়া কর্মকর্তা ও সদস্যদের তালিকা
পুলিশ সদর দপ্তর থেকে প্রেরিত এক ঘোষণায় জানানো হয়, গত বছরের ১১ জানুয়ারি থেকে চলতি বছরের ২৮ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত বিভিন্ন অবদান বিবেচনায় মোট ৬২ জন সদস্যকে পদক দেওয়া হয়েছে।
এর মধ্যে উল্লেখযোগ্যরা হলেন: সাবেক আইজিপি মো. ময়নুল ইসলাম, র্যাব মহাপরিচালক একে এম শহিদুর রহমান, সিএমপি কমিশনার হাসিব আজিজ, ডিএমপির যুগ্ম কমিশনার মোহাম্মদ নাসিরুল ইসলাম, খাগড়াছড়ির পুলিশ সুপার মো. আরেফিন জুয়েল, ডিএমপির এএসআই মো. মেসবাহ উদ্দিনসহ অনেকে।
এছাড়া, পদকপ্রাপ্তদের মধ্যে রয়েছেন মাঠ পর্যায়ের কয়েকজন সাহসী সদস্যও। যেমন, গুলশান বিভাগের এক পুলিশ সদস্য যিনি ছিনতাইকারীকে ছুরিকাঘাতের পরও ধরতে সক্ষম হয়েছিলেন— তাকেও বিপিএম প্রদান করা হয়েছে।
বাদ পড়লেন বিতর্কিত ওসি
দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ থানার ওসি মনিরুল হক ডাবলুর নাম প্রাথমিকভাবে তালিকাভুক্ত হলেও পরে গণমাধ্যমে নেতিবাচক খবর প্রকাশের পর তাকে বাদ দেওয়া হয়। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় তার নাম অন্তর্ভুক্তির চূড়ান্ত তালিকা থেকে প্রত্যাহার করে নেয়।
আইজিপির ব্যাখ্যা
পুলিশ মহাপরিদর্শক (আইজিপি) বাহারুল আলম সাংবাদিকদের বলেন, "সাধারণত আবেদন ও মাঠ পর্যায়ের সুপারিশের ভিত্তিতে পদক প্রদান করা হয়। তবে সাহসিকতা বা ব্যতিক্রমী অবদানের ক্ষেত্রে স্বপ্রণোদিতভাবেও সদস্য নির্বাচন করা হয়।"
বিশ্লেষকরা বলছেন, যদিও আইজিপির ব্যাখ্যায় পদ্ধতিগত শুদ্ধতার কথা বলা হয়েছে, বাস্তবে আবেদনের ভিত্তিতে পদক প্রদানের রীতি বিশ্বমানের পুলিশ বাহিনীতে নেই। অধিকাংশ দেশে নিরপেক্ষ কমিটি নিজস্বভাবে কাজের স্বীকৃতি নির্ধারণ করে।
অতীতের পরিসংখ্যান
গত ১৫ বছরে প্রায় দুই হাজার পুলিশ সদস্যকে বিপিএম ও পিপিএম প্রদান করা হয়েছে। এর মধ্যে ২০২৪ সালে সর্বোচ্চ— প্রায় ৪০০ পুলিশ সদস্য পদক পান। সেবার জাতীয় সংসদ নির্বাচনে পুলিশ বাহিনীর ভূমিকার পুরস্কার হিসাবে এই বিপুলসংখ্যক পদক দেওয়া হয়।
২০১৮ সালেও ব্যতিক্রম ছিল না; সেবার ১৮২ জন পুলিশ সদস্য পদক পেয়েছিলেন।
সমালোচকরা যা বলছেন
বিরোধীদলীয় নেতারা এবং স্বাধীন পর্যবেক্ষকরা বলছেন, "পদক এখন আর সম্মানের প্রতীক নয়, বরং সরকারের আনুগত্যের দাম। মেধাবী, সৎ ও সাহসী পুলিশ সদস্যদের হতাশ করে দলকানা কর্মকর্তাদের উৎসাহিত করার মাধ্যমে পুলিশ বাহিনীর পেশাদারিত্বে ভয়াবহ চিড় ধরছে।"
এছাড়া পুলিশের ভেতর থেকেই কেউ কেউ বলছেন, "যখন পরিশ্রম আর সততা মূল্যায়ন পায় না, তখন বাহিনীতে চাটুকারিতাই একমাত্র সাফল্যের মাপকাঠি হয়ে ওঠে।"
বাংলাবার্তা/এমএইচ