
ছবি: সংগৃহীত
মিয়ানমারের গৃহযুদ্ধপীড়িত রাখাইন রাজ্যে জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে একটি ‘হিউম্যানিটারিয়ান প্যাসেজ’ বা মানবিক করিডোর স্থাপন নিয়ে সরকারের পক্ষ থেকে কোনো চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত এখনো গৃহীত হয়নি। এ নিয়ে সম্প্রতি সামাজিক ও রাজনৈতিক অঙ্গনে উদ্বেগ ও প্রশ্নের পরিপ্রেক্ষিতে সরকারের অবস্থান স্পষ্ট করেছেন প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম। তিনি জানিয়েছেন, এই সংবেদনশীল ইস্যুতে সরকার এখনও আলোচনার পর্যায়ে রয়েছে এবং সকল প্রাসঙ্গিক স্টেকহোল্ডারের সঙ্গে পরামর্শ শেষে নীতিনির্ধারণী সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হবে।
প্রেস সচিব শফিকুল আলম সম্প্রতি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে একটি বিস্তারিত পোস্টের মাধ্যমে এই বিষয়ে সরকারের অবস্থান তুলে ধরেন। সেখানে তিনি বলেন, “সরকার এখনো জাতিসংঘ কিংবা অন্য কোনো আন্তর্জাতিক সংস্থার সঙ্গে ‘মানবিক করিডোর’ প্রতিষ্ঠা নিয়ে আনুষ্ঠানিক আলোচনা করেনি। রাখাইন রাজ্যে যদি জাতিসংঘের নেতৃত্বে কোনও মানবিক সহায়তা পরিচালিত হয়, সেক্ষেত্রে বাংলাদেশ নীতিগতভাবে কেবলমাত্র রসদ সহায়তার কথা বিবেচনা করতে পারে।”
তার এই বিবৃতি এসেছে এমন এক সময়, যখন আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম ও কূটনৈতিক মহলে আলোচিত হচ্ছে যে, বাংলাদেশ হয়তো রাখাইনে প্রবেশের একটি করিডোর জাতিসংঘের জন্য উন্মুক্ত করতে যাচ্ছে। কিছু বিশ্লেষক একে একটি বৃহৎ ভূ-রাজনৈতিক শক্তির অংশ হিসেবে দেখছেন, যা বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব ও নিরাপত্তার জন্য উদ্বেগের বিষয় হতে পারে। এমনকি বাংলাদেশের একটি প্রভাবশালী রাজনৈতিক দল অভিযোগ করেছে যে, দেশের গুরুত্বপূর্ণ অংশীদারদের সঙ্গে আলোচনা না করেই করিডোরের বিষয়ে পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে, যা গ্রহণযোগ্য নয়।
এসব প্রশ্নের জবাবে প্রেস সচিব স্পষ্ট ভাষায় জানান, “বাংলাদেশ মানবিক দুর্যোগে সবসময় সক্রিয় থেকেছে এবং অতীতেও তা প্রমাণিত হয়েছে। মিয়ানমারে ভয়াবহ ভূমিকম্পসহ চলমান গৃহযুদ্ধ পরিস্থিতিতে আমরা উদ্বিগ্ন যে, যদি সংকট অব্যাহত থাকে, তাহলে রাখাইন থেকে বাংলাদেশে নতুন করে শরণার্থী ঢল নামতে পারে, যা বর্তমান বাস্তবতায় আমাদের পক্ষে বহনযোগ্য নয়।”
তিনি আরও বলেন, “আমরা বিশ্বাস করি, জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে পরিচালিত মানবিক সহায়তা রাখাইন রাজ্যের স্থিতিশীলতা পুনঃপ্রতিষ্ঠায় সহায়ক হবে। পাশাপাশি, এটি সেখানে পরিস্থিতি এমনভাবে উন্নয়নে ভূমিকা রাখবে, যাতে বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনের পথ সহজ হয়।”
জাতিসংঘের উন্নয়ন কর্মসূচির (UNDP) তথ্যমতে, রাখাইন রাজ্যে বর্তমানে তীব্র মানবিক সংকট চলছে। এই প্রেক্ষাপটে যদি কোন আন্তর্জাতিক সাহায্য পৌঁছে দিতে হয়, তাহলে সেটির সবচেয়ে কার্যকর রুট হতে পারে বাংলাদেশের ভূখণ্ড ব্যবহার করে তা সরবরাহ করা। তবে এ রকম কোন মানবিক করিডোর চালু করার আগে সরকার কোনো তড়িঘড়ি সিদ্ধান্তে যাবে না বলেই আশ্বস্ত করেছেন প্রেস সচিব।
শফিকুল আলম তার বিবৃতিতে ‘বিদ্বেষপূর্ণ প্রচারণা’ সম্পর্কেও মন্তব্য করেন। তিনি বলেন, “গত কয়েক মাস ধরেই আমরা লক্ষ্য করছি, বাংলাদেশের বিরুদ্ধে ধারাবাহিকভাবে মিথ্যা ও বিভ্রান্তিকর তথ্য ছড়ানো হচ্ছে। মানবিক করিডোর ইস্যুতেও একই ধরনের অপপ্রচার চালানো হচ্ছে। এটি কোনো বাস্তবতার ভিত্তিতে নয়, বরং ষড়যন্ত্রমূলক গুজব মাত্র।”
প্রসঙ্গত, জাতিসংঘের পক্ষ থেকে বাংলাদেশের প্রতি আহ্বান জানানো হয়েছে, যেন রাখাইন অঞ্চলে ত্রাণ সরবরাহের জন্য একটি নির্দিষ্ট পথ খোলা রাখা হয়। তবে এর মানে এই নয় যে, বাংলাদেশ চূড়ান্তভাবে কোনো ভূখণ্ড বা নিরাপত্তা জটিলতায় জড়াতে যাচ্ছে। সরকারের অবস্থান পরিস্কার—যেকোনো মানবিক কার্যক্রম শুরু করার আগে বাংলাদেশ তার নিরাপত্তা, কূটনৈতিক স্বার্থ এবং জনগণের উদ্বেগকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করবে।
এখন প্রশ্ন উঠছে, সরকার যেহেতু মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে একটি সহযোগিতামূলক মনোভাব দেখাচ্ছে, তাহলে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় কতটা দায়িত্বশীলভাবে এগিয়ে আসবে এই সংকট সমাধানে? এবং বাংলাদেশ তার দীর্ঘস্থায়ী শরণার্থী সংকট মোকাবিলায় কিভাবে আন্তর্জাতিক সহানুভূতি ও সমর্থন আদায় করতে পারবে?
সিদ্ধান্ত যাই হোক, তা হবে পর্যালোচনার মাধ্যমে, জাতীয় নিরাপত্তা এবং আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা বিবেচনায় রেখে—এটি পরিষ্কারভাবে জানিয়ে দিয়েছে বাংলাদেশ সরকার।
বাংলাবার্তা/এমএইচ