
ছবি: সংগৃহীত
প্রায় এক কোটির মতো প্রবাসী বাংলাদেশিকে জাতীয় ভোটের আওতায় আনতে চায় নির্বাচন কমিশন (ইসি)। এক যুগেরও বেশি সময় ধরে আলোচিত এই বিষয়ে এবার দৃশ্যমান উদ্যোগের ইঙ্গিত মিলেছে নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) আবুল ফজল মো. সানাউল্লাহর বক্তব্যে। তিনি জানিয়েছেন, প্রবাসী ভোটারদের অন্তর্ভুক্ত করাকে নির্বাচন কমিশনের অন্যতম লক্ষ্য হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে। কারণ, এটি কেবল ভোটারের অধিকার নিশ্চিত করার বিষয় নয়, বরং গণতন্ত্রের পরিপূর্ণতা ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের দিকেও একটি বড় পদক্ষেপ।
প্রবাসী ভোটারদের গুরুত্বের জায়গা
মঙ্গলবার (২৯ এপ্রিল) রাজধানীর নির্বাচন ভবনের অডিটোরিয়ামে আয়োজিত ‘প্রবাসী বাংলাদেশিদের ভোটাধিকার’ বিষয়ক অংশীজন সংলাপে সানাউল্লাহ বলেন, “প্রবাসী ভোটাররা আমাদের মোট ভোটারদের প্রায় ১০ শতাংশ। এ বিশাল জনগোষ্ঠী দীর্ঘদিন ধরে জাতীয় নির্বাচনের বাইরে রয়েছেন। এটি একটি গণতান্ত্রিক শূন্যতা। আমরা সেই শূন্যতা পূরণ করতে চাই। প্রবাসীদের ভোটিং সিস্টেমে আনাটা এখন প্রয়োজন।”
তিনি আরও বলেন, “১৭৮টি দেশের মধ্যে ১১৫টি দেশে প্রবাসীরা ভোট দিতে পারে। কিছু দেশে দেখা গেছে, প্রবাসী ভোটারদের অংশগ্রহণ দেশীয় ভোটারদের চেয়ে বেশি। এটি প্রমাণ করে—বিদেশে থাকলেও তারা নিজ দেশের রাজনীতি, গণতন্ত্র ও ভবিষ্যৎ নিয়ে গভীরভাবে চিন্তিত ও আগ্রহী।”
অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের পথে নতুন সংযোজন
সংলাপটিতে বিএনপি, অন্যান্য রাজনৈতিক দল, সুশীল সমাজ, নির্বাচন পর্যবেক্ষক এবং গণমাধ্যমকর্মীরা উপস্থিত ছিলেন। দীর্ঘ আলোচনা, প্রশ্নোত্তর ও প্রস্তাবনায় উঠে আসে—প্রবাসী ভোটের ব্যবস্থা চালু হলে নির্বাচনের স্বচ্ছতা ও প্রতিনিধিত্ব আরও বিস্তৃত হবে।
সানাউল্লাহ বলেন, “জাতীয় নির্বাচনে প্রবাসীদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা মানেই শুধু ভোট দেওয়া নয়, বরং জাতীয় সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় তাদের সংযুক্ত করা। এটি আমাদের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে আরও দৃঢ় করবে।”
বড় চ্যালেঞ্জ—কিন্তু সম্ভাবনার দুয়ারও উন্মুক্ত
প্রবাসীদের ভোটাধিকার নিশ্চিত করা কোনো সহজ কাজ নয়—এ কথা ইসিও স্বীকার করে। এটি প্রযুক্তি, আইনি কাঠামো, কূটনৈতিক সমন্বয় ও পর্যাপ্ত প্রস্তুতির ওপর নির্ভর করে। নির্বাচন কমিশনের সিনিয়র সচিব মো. আখতার হোসেন বলেন, “আমরা জানি—এই উদ্যোগে জটিলতা রয়েছে। তবে আজকে এই সংলাপ প্রমাণ করে, আমরা সংকল্পবদ্ধ।”
তিনি বলেন, “প্রবাসীরা যদি ভোট দিতে না পারেন, তাহলে ভোটের কাস্ট হারে প্রভাব পড়ে। আমরা চাই সর্বোচ্চ অংশগ্রহণের মাধ্যমে একটি উৎসবমুখর নির্বাচন। সেই উৎসবে প্রবাসীরাও যেন যুক্ত হতে পারেন।”
প্রবাসীদের ভোটাধিকার: আন্তর্জাতিক দৃষ্টান্ত
অনেক দেশেই প্রবাসী নাগরিকরা ডাকযোগে, দূতাবাসে গিয়ে বা অনলাইনের মাধ্যমে ভোট দিয়ে থাকেন। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ভারত, ফ্রান্স, ফিলিপাইনসহ বহু দেশে প্রবাসী ভোটারদের জন্য বিশেষ ব্যবস্থাপনা রয়েছে। সানাউল্লাহ বলেন, “আমরা এসব দেশের অভিজ্ঞতা পর্যালোচনা করছি। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে কেমন পদ্ধতি কার্যকর হবে—তা নির্ধারণে গবেষণা ও প্রযুক্তিগত মূল্যায়ন চলছে।”
রাজনৈতিক দলগুলোর অবস্থান ও মতামত
সংলাপে বিএনপি ও জাতীয় পার্টিসহ কয়েকটি রাজনৈতিক দল অংশ নেয়। তারা প্রবাসী ভোটারদের অন্তর্ভুক্তিকে নীতিগতভাবে সমর্থন জানালেও প্রশ্ন তোলে প্রক্রিয়াটি কতটা স্বচ্ছ, নিরাপদ ও বাস্তবায়নযোগ্য হবে তা নিয়ে।
একজন অংশগ্রহণকারী বলেন, “আমরা চাই প্রবাসীদের ভোটাধিকার নিশ্চিত হোক, কিন্তু কোনোভাবেই যেন এটি কারচুপি বা প্রযুক্তিগত দুর্বলতার সুযোগ না হয়। ইসিকে কঠোরভাবে প্রযুক্তি ও স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে হবে।”
সম্ভাব্য ভোটপদ্ধতি: ডাকযোগ, ই-ভোটিং না দূতাবাস?
ইসি সূত্র জানায়, প্রাথমিকভাবে তিনটি মডেল নিয়ে ভাবনা চলছে—
১. দূতাবাসে ভোটকেন্দ্র স্থাপন
২. ডাকযোগে ব্যালট পাঠিয়ে ভোট সংগ্রহ
৩. ইলেকট্রনিক ভোটিং (অনলাইন প্ল্যাটফর্ম)
তবে এ তিনটির কোনটি বাস্তবায়নযোগ্য হবে তা এখনও নিশ্চিত নয়। একটি উচ্চ পর্যায়ের বিশেষজ্ঞ কমিটি এ নিয়ে সুপারিশ প্রণয়নের কাজ করছে।
গণতন্ত্রে প্রবাসীদের যুক্ত করার সময় কি এবার?
বাংলাদেশের প্রবাসী জনগোষ্ঠী কেবল রেমিট্যান্সের উৎস নয়, বরং তারা দেশের অর্থনীতি, সংস্কৃতি ও রাজনৈতিক চেতনায়ও গুরুত্বপূর্ণ অংশ। কিন্তু বছরের পর বছর ধরে তারা জাতীয় নির্বাচনের বাইরে থেকেছেন। এবার নির্বাচন কমিশনের এই পদক্ষেপ আশা জাগাচ্ছে—এটা শুধু নির্বাচনী পরিসংখ্যান নয়, এটি অংশগ্রহণমূলক গণতন্ত্রের পথচলার একটি গাঢ় পদচিহ্ন।
এই উদ্যোগের সফলতা নির্ভর করবে রাজনৈতিক সদিচ্ছা, প্রযুক্তি ব্যবহার, আইনি কাঠামো এবং সবচেয়ে বেশি—নির্বাচন কমিশনের স্বচ্ছতা ও নিষ্ঠার ওপর।
বাংলাবার্তা/এমএইচ