ছবি: বাংলাবার্তা
বাংলাদেশের কৃষি অনেকাংশ প্রকৃতি নির্ভর। ভূপ্রকৃতিগত কারণে বা এবং জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে প্রায় প্রতি বছর দেশে প্রাকৃতিক দুর্যোগ আঘাত হানে। যার প্রভাবে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় কৃষি এবং এর সঙ্গে সম্পৃক্ত কৃষক জনগোষ্ঠী।
বাংলাদেশে কৃষিতে বর্তমানে যে ঝুঁকিগুলো তাৎপর্যপূর্ণ তাদের মধ্যে প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে শস্যহানি অন্যতম। প্রাকৃতিক নানা দুর্যোগের কারণে একদিকে যেমন কৃষির উৎপাদন ব্যাহত হয় অন্যদিকে কৃষকদের আর্থিক ঝুঁকি বৃদ্ধি পায়। আশির দশকে দেশে প্রথম শস্য বীমার উদ্যোগ নেওয়া হলেও সেটি নানান কারণে কৃষকদের মাঝে আগ্রহ তৈরি করতে সক্ষম হয়নি।
শুরুতে যে ধরনের ভর্তুকি বা সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা এবং ব্যবস্থাপনা প্রয়োজন ছিল বাস্তবায়নকারী সরকারি প্রতিষ্ঠান, সাধারণ বীমা করপোরেশন তা নিশ্চিত করতে পারেনি। সরকারি নির্দেশনা মেনে কয়েক দফা উদ্যোগ নিলেও তা সফল হয়নি। তবে বিগত সময়ে সফল না হলেও শস্য বীমা চালুর যৌক্তিকতা কমেনি বরং সাম্প্রতিক সময়ে আরও বৃদ্ধি পেয়েছে।
সাম্প্রতিককালে আমরা লক্ষ্য করেছি, কৃষি কাজ প্রাকৃতিক বিপর্যয় যেমন খরা, অতি বৃষ্টি, বন্যা, অনিশ্চিত আবহাওয়া পরিবর্তন, টর্নেডো এবং নানান রোগ-বালাই প্রভৃতির প্রতি আগের চেয়ে বেশি সংবেদনশীল। সংবাদপত্রে প্রায়শ দেখা যায় নানান কারণে কৃষক ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে।
যেমনটি আমরা লক্ষ্য করেছি, সাম্প্রতিক সময়ে দেশের পূর্বাঞ্চল এবং উত্তরাঞ্চলে ব্যাপক বন্যার দেখা দেয় যার ফলে প্রচুর ফসলহানি ঘটে। প্রাকৃতিক দুর্যোগজনিত ঝুঁকি আগের চেয়ে আরও বেড়েছে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে বাজার ঝুঁকি। এটি খুব দুঃখের যে, বাংলাদেশ প্রধানত কৃষিভিত্তিক অর্থনীতির দেশ হলেও কৃষির উন্নয়ন এবং ঝুঁকি মোকাবিলায় যুগান্তকারী পদক্ষেপ প্রতীয়মান হয় না।
এটি শুধু কৃষকেরই ক্ষতি নয়, গোটা দেশের ক্ষতি। ফসলের ক্ষতিতে খাদ্যের মূল্য বৃদ্ধি পায় যা দেশের সবাইকে প্রভাবিত করে। কৃষকের এই ক্ষতি পুষিয়ে নেওয়া সম্ভব যদি দেশের সব কৃষককে তার ফসলের বীমার আওতায় আনা যায়। এগুলো বিবেচনায় নিয়ে শস্য বীমা চালু এবং বাস্তবায়ন করলে কৃষকদের মনোবল দৃঢ় থাকবে এবং আর্থিক ক্ষতির হাত থেকে তারা রক্ষা পাবে।
কৃষি বা শস্য বীমা হচ্ছে ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা হাতিয়ার যা কৃষককে তার ফসলের উৎপাদন ক্ষতির বিপরীতে আর্থিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারে। কৃষি বীমার অধীনে কৃষককে অল্প কিছু অর্থ প্রিমিয়াম হিসেবে কোনো বীমা কোম্পানিকে দিতে হয় যাতে কোনো ঝুঁকি যেমন বন্যা, খরা, রোগ-বালাই থেকে একটি আর্থিক নিরাপত্তা নিশ্চিত হয়। কৃষি বা শস্য বীমা হচ্ছে ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা হাতিয়ার যা কৃষককে তার ফসলের উৎপাদন ক্ষতির বিপরীতে আর্থিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারে।
এই কাভারেজ সুনির্দিষ্ট সময়ের জন্য সাধারণত একটি শস্য মৌসুম কিংবা বছরের জন্য হয়ে থাকে যেখানে কৃষক ক্ষতির মুখোমুখি হলে কোম্পানি তা পুষিয়ে দেওয়ার অঙ্গীকার করে। যাতে ক্ষতির ঘটনা ঘটার পূর্বে কৃষক যে আর্থিক অবস্থায় ছিল, ফসলের ক্ষতি হলেও কৃষক সেই অবস্থাতেই ফিরতে পারে।
কৃষকেরা অনেকে ক্ষুদ্র ঋণ নিয়ে কিংবা ধারে কৃষি উপকরণ কিনে চাষাবাদ করেন। যখন কৃষক ক্ষতির সম্মুখীন হন, তখন ধার করা অর্থ পরিশোধের সামর্থ্য হ্রাস পায় যা পরবর্তীকালে কৃষিতে বিনিয়োগকে বাধাগ্রস্ত করে। সেক্ষেত্রে কৃষি বীমা এই ঝুঁকির হাত থেকে কৃষককে নিরাপত্তা দিতে পারে এবং কৃষি কর্মকাণ্ডকে অটুট রাখতে সহায়তা করে।
অন্যদিকে, কৃষি বীমা চালু হলে কৃষকরা বাণিজ্যিক ব্যাংক থেকে সহজে ঋণ পেতে সক্ষম হবে। দেশের বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো বছরের পর বছর ধরে কৃষি কাজকে খুব ঝুঁকিপূর্ণ বলে অভিহিত করে ঋণদানে বিরত থাকে। বীমা থাকলে বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানগুলো আর সেটি মনে করবে না এবং কৃষিতে ঋণের প্রবাহ বাড়লে কৃষি উৎপাদন বাড়বে, কৃষকের জীবন যাত্রার মান বাড়বে।
যেসব দেশে কৃষি বীমা চালু হয়েছে সেখানে দেখা যায় এই প্রকল্প থেকে কৃষকেরা ব্যাপকভাবে উপকৃত হয়েছেন। বীমা থাকায় ক্ষতিপূরণের মাধ্যমে কৃষকরা তাদের কৃষি আয় বৃদ্ধি করতে পেরেছে। তাদের কৃষি উদ্যোগ এবং প্রকল্পগুলো প্রসারিত করতে পারে। যার ফলে তাদের জীবন যাত্রার মান উন্নত হয়েছে। ফলে কৃষকদের কৃষি প্রচেষ্টাকে অপ্রত্যাশিত ঝুঁকি থেকে রক্ষা করার জন্য কৃষি বীমা ব্যবস্থা গ্রহণ করা জরুরি হয়ে উঠেছে। তবে এক্ষেত্রে প্রত্যক্ষ সরকারি সহযোগিতা প্রয়োজন। সরকারি উদ্যোগে এবং খরচে কৃষি বীমা স্কিম চালু করার মধ্য দিয়ে সরকার শুরুটা করতে পারে, যেখানে কৃষকদের জন্য ভর্তুকি যুক্ত বীমার সুযোগ প্রদান করবে। যার অধীনে কৃষক বিভিন্ন শস্য, হাস-মুরগি, পশু ও মৎস্য সম্পদসহ বিভিন্ন ঝুঁকিগুলো কাভার করতে সক্ষম হবে।
এটি সত্য যে, বাংলাদেশের কৃষি খাত অর্থনীতির ভিত্তিপ্রস্তর হিসেবে কাজ করে, জনসংখ্যার একটি বড় অংশের ভরণ-পোষণ প্রদান করে এবং রপ্তানি আয়ে উল্লেখযোগ্যভাবে অবদান রাখে। দেশের জনসংখ্যার একটি উল্লেখযোগ্য অংশের খাদ্য চাহিদা যাদের ওপর নির্ভর করে এবং আমাদের রপ্তানি আয়ে প্রচুর অবদান রাখে যারা এমন কৃষকদের উচ্চ উৎপাদন ঝুঁকির বিরুদ্ধে সুরক্ষার মাধ্যমে এই খাতে বিনিয়োগ বাড়ানোর লক্ষ্যে শস্য বীমা উদ্যোগ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।
ঝুঁকি প্রশমন কৌশলের মাধ্যমে সরকার কৃষি খাতের গুরুত্বকে স্বীকৃতি দিয়ে, কৃষি শিল্পে বর্ধিত বিনিয়োগকে উৎসাহিত করতে পারে। এই ধরনের কৃষি বীমার প্রভাব কৃষকদের ঝুঁকি কমানোর বাইরেও এর সুদুরপ্রসারী প্রভাব রয়েছে। এটি কৃষি খাতে প্রবৃদ্ধি এবং স্থায়িত্বকে উন্নীত করবে। কৃষি বীমাতে সরকার বিনিয়োগ করে ভবিষ্যতের পথ প্রশস্ত করতে পারে যেখানে বাংলাদেশের প্রতিটি কৃষকের নিকট প্রয়োজনীয় এই আর্থিক নিরাপত্তায় সুযোগ থাকবে। লেখক: অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়
বাংলাবার্তা/এমআর