ফাইল ছবি
প্রয়াস, প্রত্যয়, প্রচেষ্টা ও অধ্যবসায় মানুষকে মননশীল করে তোলে। মেধা ও মননের সৃজনে মানবের চিত্তলোক উর্বর ও প্রফুল্ল হয়। প্রস্ফূটিত হয়। প্রজ্জ্বলিত হয়। সুপথে হাঁটতে শেখেন। সুস্থ্যধারার কার্যক্রমে আবদ্ধ মানুষগুলো মানুষের জন্য ভাবেন। ভাবেন দেশ ও সমাজের জন্যও। অনন্ত অকৃপণতায় আলোর বিচ্ছুরণ ঘটান। হিতৈষীতায় জ্বালান আলোকবর্তিকা। প্রজন্মকে আলোর পথে টানেন, আলো আর অগ্রযাত্রার পথ দেখান। সংবাদ ও সংবাদের মানুষগুলো এক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা রাখেন। মফস্বলের সাংবাদিকদের দায়িত্ব, কর্তব্য, ন্যায়নিষ্ঠতা ও দায়বদ্ধতার গুরুত্বও কম নয়। তবে দায়িত্বশীল অবস্থায় ও অবস্থানে থেকেও আমরা অনেকেই পাশ কাটিয়ে চলি, এড়িয়ে যাই। দায়বদ্ধতা ও জবাবদিহিতার জায়গাগুলো বেমালুম ভুলে গিয়ে হিংসা-দ্বেষে নিপতিত হয়ে কলুষ করে চলেছি মহান এই পেশাকে। অজ্ঞাত কারণে, জানা-অজানা, চেনা-অচেনার কাছে আষ্ঠেপৃষ্ঠে বাঁধা পড়ছি। ‘সৎ মায়ের হাতে শিশুর বলি’- এ খবর এড়িয়ে ‘গুল খেয়ে আত্মহত্যা’র খবর নিয়ে মাতামাতি করছি। বিচলিত হয়ে পড়ছি।
প্রতিটি মানুষই কোনো না কোনোভাবে সংবাদদাতা। এ ক্ষেত্রে স্থান, কাল, সময়, পাত্র, ক্ষেত্র ও পেশার ভিন্নতা থাকতে পারে। প্রত্যেকেই সংবাদদাতা হলেও প্রত্যেকেই রিপোর্টার, সংবাদকর্মী বা সাংবাদিক নন। সংবাদদাতা, সংবাদকর্মী, সাংবাদিক ও রিপোর্টার শব্দের আভিধানিক অর্থ প্রায় একই ধরনের।
মফস্বলের সাংবাদিকতায় যে বিষয়টি পুঞ্জিভূত- সেটি হলো, হিংসা-দ্বেষ। কেউ কারও এগিয়ে যাওয়া, অর্জন, প্রাপ্তি ইত্যাদি ভালো চোখে দেখেন না। পরনিন্দা ও পরচর্চায় সোচ্চার হয়ে ওঠেন। ঐক্যমতে ফাটল দেখা দেয়। সহাবস্থান বিচ্ছিন্ন হয়। ভাগে ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়েন জাতির বিবেক। ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন হয়। সমাজে নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। এছাড়া, রাজনৈতিক রঙ ও আভায় সন্নিবেশিত হয়ে কেবল সাংবাদিকরাই নন, শিক্ষক, চিকিৎসক, প্রকৌশলী ও আইনজীবীসহ অনেকেই পেশাদারিত্ব ও দায়বদ্ধতার জায়গা থেকে সরে পড়ছেন।
মফস্বল এলাকাগুলোতে সংবাদকর্মী বাড়লেও বাড়েনি সংবাদ। উপজেলা পর্যায়ের বা গুরুত্বপূর্ণ এলাকার অনেক সাংবাদিক এখনও ‘নিউজ’ লিখতে পারেন না। একটি সাধারণ ঘটনার তথ্য-উপাত্ত্বও সংগ্রহ করতে শেখেননি, সংবাদ লেখাতো দূর! অথচ তারা সাংবাদিক। মূল ধারার প্রকৃত সাংবাদিকদের সাথে এ ধরনের নামধারী কথিত সংবাদকর্মীরা সখ্যতা গড়ে তোলেন মূলত তাদের থেকে নিউজের সুবিধা নেওয়ার জন্য। যারা কাজ করেন তারাই মূলত নামকাওয়াস্তের কার্ডধারী ওইসব সংবাদকর্মীদের হেড অফিসের মেইলে নিউজ সেন্ড করে দেন। মফস্বলের এলাকা বা উপজেলাগুলোর প্রকৃত সাংবাদিক মাঠে-ময়দানে কাজ করেন, ঘটনার খুব কাছাকাছি যাওয়ার চেষ্টা করেন এবং সময় ও মেধা ব্যয় করে ‘নিউজ’ বা ‘সংবাদ’ তৈরি করেন। নিজ নিজ হাউজে সেন্ড করেন। অনেকে আবার সংবাদ-টংবাদের ধারও ধারেন না। পত্রিকার একটা কার্ড নিয়েই দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন। মোটরসাইকেলে পত্রিকার লোগো/স্টিকার সেঁটে বীরদর্পে চলছেন। কারও কারও মোটরসাইকেলের রেজিস্ট্রেশন নাম্বার পর্যন্ত নেই। অনেকে আবার ফেসবুক নির্ভর সাংবাদিকতা করেন। পত্রিকায় তাদের কোনো নিউজ নেই। অসঙ্গতিপূর্ণ বা অপরিপূর্ণ বা অপরিপক্ক বাক্যে কিছু কথা লিখে ছবিসহ ফেসবুকে পোস্ট করছেন। এমন অনেক উপজেলা রয়েছে যেখানে সংবাদকর্মীর তালিকা করলে ১৫ থেকে ৭৫ হবে! অথচ সেখানে নিয়মিত কাজ করেন এমন সাংবাদিকের সংখ্যা ১০/১২-এর বেশি নয়। বিষয়টি লজ্জাজনক হলেও সত্যি। মূল ধারার সাংবাদিকদের থেকে কথিত সাংবাদিকের সংখ্যা বেশি হওয়ায় প্রকৃতদের বিড়ম্বনার শিকার হতে হয়। নাম সর্বস্ব সংবাদকর্মীদের অবাধ বিচরণে এবং অহেতুক-অকারণে এ অফিস, ও অফিস করে বেড়ানোয় পেশার মান এবং পেশাদারিত্ত্বের গ্রহণযোগ্যতা-মর্যদা ক্ষুন্ন হচ্ছে।
মফস্বলের অনেক সাংবাদিক আছেন যাদের দু’লাইন খবর ছাপা হলে পত্রিকা বোগলে নিয়ে ঘোরেন। দেখান নানান মানুষকে। বাহবা কুড়ানোর চেষ্টা করেন। অনেকটা ঢোল পিটিয়ে প্রচারণার মতোই। এভাবেই নকলনবীস সাংবাদিকদের দৌরাত্ম ও হুড়োহুড়িতে প্রকৃত পরিশ্রমি সাংবাদিকরা নানান সময় নানান জায়গায় অপ্রস্তুত ও অপদস্ত হন। লজ্জা পান। ক্ষুব্ধ হন। এটা অনাকাঙ্খিত বাস্তবতা। বাহবা প্রত্যাশী নকলনবীস ও তিলকে তাল বানানো এসব সাংবাদিকদের অবাধ দৌরাত্ম ও বিচরণে বেকায়দায় পড়ছেন প্রকৃত-প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত সাংবাদিকরা। এটিই হচ্ছে মফস্বল সাংবাদিকতার বাস্তব চিত্র।
অনুসরণ করা ভালো তবে অনুকরণ করা নয়। সুস্থ্য চর্চা ও প্রতিযোগিতার মাধ্যমে দক্ষতা-যোগ্যতা অর্জণ করতে হয়। এ জন্যে দরকার প্রত্যয়, প্রচেষ্টা, পরিশ্রম ও অধ্যবসায়। প্রকৃত শিক্ষার অভাব থাকলে ইতিবাচক চেতনার বিকাশ ঘটে না। এসব প্রকৃতির সাংবাদিকরা সর্বদা নেতিবাচক ভাবনার মধ্যে ডুবে থাকেন। এরা একটা ছোট্ট গন্ডিতে আবদ্ধ। বন্দিত্বের জাল ছিড়ে বেরুতে ব্যর্থ হন। শুভ ব্রত নিয়ে দীর্ঘ সাধনায় অনেক দূর পর্যন্ত এগুনো সম্ভব। কিন্তু সংকীর্ণতায় আচ্ছাদিতরা আস্তাকুড়ে নিক্ষিপ্ত হবেন- এটাইতো স্বাভাবিক। বিচ্ছিন্ন ও বিক্ষিপ্তভাবে চর্চা করলে কোনো ক্ষেত্রেই সফলতা আসে না। এখানে দীর্ঘ সময় নিয়োগ ও মেধার প্রয়োগ নিহিত। নিয়ত বন্দিশালায় থেকে সপ্তাহের দুই/একদিন অন্যের বাহনে, অন্যের কাঁধে ভর করে কতোটা দূরই বা অতিক্রম করা যায়! প্রয়োজন স্বাধীনতা। পথ চলার স্বাধীনতা। সীমাবদ্ধতার পরিধি পেরোনোর স্বাধীনতা। লেখার স্বাধীনতা। নির্দিষ্ট ও ধরাবাঁধা সময়ের মধ্যে থেকে; অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছনো দুরুহ-কঠিন।
কেউ ফুলটাইম সাংবাদিক। কেউ হাফটাইম (পার্ট টাইম)। সাংবাদিকতা পেশাটি অনেকটা লোহার ছুরি-কাটারির মতো। অবিরত যত্ন নিলে, কাজ করলে দিনকে দিন ধারালো হয়ে হঠে। ঘষতে ঘষতে চকচকে হয়। যেন নতুন প্রতিদিন। এটা মননে লালনের ব্যাপার। অন্যথায় ফাঁকফোঁকরে ও দায়সারাভাবে কাজটি করলে জং তো (মরিচা) ধরবেই। সাংবাদিকতায় যিনি যতোবেশি সময় দিতে পারবেন, দৌড়ঝাপ করতে পারবেন, সত্যানুসন্ধানে ঘটনার খুব কাছাকাছি যেতে পারেবন এবং বাস্তব ঘটনার নিগুঢ় বর্ণনা দিতে সক্ষম হবেন- তিনি পেশায় সফল হবেন। একই সাথে পাঠকের কাছেও গ্রহণযোগ্য হয়ে উঠবেন। অন্যকোনো পন্থা বা উপায়ে ব্যত্বয় তো ঘটবেই। সাংবাদিক হওয়াটা হয়তো অনেক সহজ কিন্তু দায়বদ্ধতা থেকে দায়িত্ব পালন করাটা অনেক কঠিন। কঠিন, পাঠকের কাছে গ্রহণযোগ্যতা অর্জন করা।
দিনের পর দিন খবর ও খবরের ছবি ধার করতে করতে মফস্বলের অনেকেই এখনও সংবাদ লেখা শিখে উঠতে পারেননি। যদিও কেউ কেউ সময় স্বাপেক্ষ্যে একটু আধটু করে সময় ব্যয় করে সংবাদের মানুষ হয়ে উঠতে গিয়ে হরহামেশায় ভুল শব্দ চয়ন ও ভুল বানানে মুখর করেন প্রস্তুতকৃত খবর। এ ধরনের নেতিবাচক মনোভাবাপন্ন মানুষগুলো হয়ে উঠছেন জাতির বিবেক-মেরুদণ্ড। ফলে পেশাদারিত্ব নিয়েও পাঠক প্রশ্ন তোলেন।
মফস্বলের সাংবাদিকরা অনেকটা ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানোর মতো অবস্থা। তাই বলে অনাদর, অবহেলা আর অবজ্ঞাভরে মহৎ পেশাটিকে কলুষিত করা নৈতিকতা বিবর্জিত। অপরাধও বটে। এটা-বিবেক ও মনুষ্যত্ব সম্পন্ন মানুষের কাম্য নয়-নিশ্চয়ই। রোদ-বৃষ্টি, শীত-কুয়াশাসহ বিভিন্ন বৈরিতা মাড়িয়ে নিরবিচ্ছিন্নভাবে সংবাদের পেছনে ছুটে চলা সংবাদের মানুষটিও সাংবাদিক। আবার দিনের পর দিন, বছরের পর বছর অন্যের তৈরি করা খবর নিয়ে এবং কখনও সখনও এদিক-ওদিক ঘুরে এসে ঘরে বসে লেখা সংবাদের মানুষটিও সাংবাদিক। দু’টোর মধ্যে যোজন যোজন ফারাক। এছাড়া বিষয় ভিত্তিক প্রশিক্ষণ না থাকার কারণে অনেকেই অজ্ঞতাবশত সাংবাদিকতার নিয়ম-নীতির যথেচ্ছ ব্যবহার করছেন। তবুও তারা বুক উঁচিয়ে চলেন। অপরাধ ও অনুশোচনাবোধ তাদের মধ্যে প্রভাব ফেলতে পারে না এক বিন্দুও। বাঘের চামড়া গায়ে পরলে বিড়াল কখনওই বাঘ হয়ে যায় না। নিজেকে বাঘ ভেবে হুঙ্কার ছেড়ে মানসিক হিংস্রতার বহিঃপ্রকাশ ঘটান। এটা বোকামির শামিল। স্টাডি না করলে মুখস্ত বুলি বেশিদিন আওড়ানো যায় না। চলতে, বলতে, শিখতে, জানতে এবং লিখতে হলে পড়তে হয়।
ব্যক্তিগতভাবে আমার দুই যুগেরও বেশি সময় ধরে সাংবাদিকতার অভিজ্ঞতায় দেখেছি, মফস্বলের অনেকেই বিভিন্ন মিডিয়ায় প্রকাশিত খবরগুলো খানিকটা রদবদল করে দায়িত্বরত পত্রিকায় প্রেরণ করছেন। শনিবারের ঘটনাকে বানিয়ে দিচ্ছেন রোববারের ঘটনা। সকালের ঘটনাকে রাতের। কারো কারো থিয়োরি ৫’এ ২৫। অর্থাৎ ৫ জন আহত হলে ২৫ জনে উন্নিত করে ফেলেন। এ রকম অগনিত ঘটনার জন্ম দিয়ে যাচ্ছেন প্রতিনিয়ত। আমার প্রশ্ন, পাঠক কাকে, কোন পত্রিকা বা মিডিয়াকে বিশ্বাস করবেন? বিভ্রান্তিতে পড়েন পাঠক। আর আমাদের সংবাদ ও সাংবাদিকতা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন সাধারণ মানুষ।
দুটো কারণ আবিষ্কার হলো। প্রথমতো- খবরটি ছাপা হবে, এ বিষয়ে খানিকটা নিশ্চত হওয়া। দ্বিতীয়তো- অধিক গুরুত্বসহকারে কাভারেজ পাওয়া। এভাবেই হুমকির মুখে পড়ছে মফস্বলের সাংবাদিকতা। পেশার ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন হচ্ছে। দায়ভার কাঁধে গিয়ে পড়ছে গোটা সাংবাদিক সমাজের উপর। ফলে হিংসা-প্রতিহিংসার সৃষ্টি হচ্ছে।
থিয়োরিক্যাল এসব পদ্ধতি থেকে আমাদের বেরিয়ে আসতে হবে। অগত্যা কারো যেনো ক্ষতি না হয়ে যায়- এটা সংবাদের মানুষগুলোর বিবেচ্য হওয়া উচিৎ। সংবাদদাতা, সংবাদকর্মী, সাংবাদিক, রিপোর্টার যায় বলি না কোনো, এসব পেশার মানুষদেরকে হিংসাত্বক মনোভাব পরিহার করতে হবে। সুস্থপ্রতিযোগিতার মাধ্যমে যোগ্যতার স্বাক্ষর রাখতে হবে। সবার আগে পাঠকের কাছে গ্রহণযোগ্যতা অর্জণ করতে হবে। তাহলেই মহান এই পেশার সুনাম-সুখ্যাতি অক্ষুন্ন ও সমুন্নত রাখা সম্ভব হবে।
লেখক : কবি ও সংবাদিক