রিজভী, মঈন খান, নজরুল, সেলিমা। ছবি : বাংলাবার্তা
দেশের অন্যতম বৃহৎ রাজনৈতিক দল বিএনপি এখন ‘চার নেতার’ দলে পরিণত হয়েছে। অথচ জাতীয় নিরর্বাহী কমিটির কর্মকর্তা ও সদস্য মিলে ৫০২ জন, চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা ৭৬ জন এবং সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ফোরাম জাতীয় স্থায়ী কমিটির ১৪ জন সদস্যসহ কেন্দ্রীয় কমিটির নেতার সংখ্যা ছয়শ’র অধিক।
এই ছয়শ’ নেতার মধ্যে এই মুহূর্তে সক্রিয় আছেন দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. আব্দুল মঈন খান, নজরুল ইসলাম খান এবং সেলিমা রহমান। লিফলেট বিতরণ, গণসংযোগ, সভা, মানবন্ধব, সেমিনার দলের সংবাদ সম্মেলনে এই তিন নেতাকে দেখা যাচ্ছে। এর বাইরে দলটির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী আত্মগোপনে থেকে প্রতিদিন একবার ‘ঝটিকা’ মিছিল, লিফলেট বিতরণ বা গণসংযোগ চালিয়ে যাচ্ছেন। বাকিদের কোনো হদিস মিলছে না।
বিএনপির সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ফোরাম ১৯ সদস্যের জাতীয় স্থায়ী কমিটির ১৭ ও ১৮ নম্বর পদ দু’টি শূন্য রেখে ২০১৬ সালের ৬ আগস্ট ১৭ সদস্যের নাম ঘোষণা করে বিএনপি। ২০১৯ সালের ২০ জুন ওই দুই শূন্য পদে দলের ভাইস চেয়ারম্যান সেলিমা রহমান ও ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকুকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। তবে, মৃত্যু, অসুস্থতা এবং রাজনীতি থেকে অবসরজনিত কারণে স্থায়ী কমিটির ৪, ৬, ৭, ৮ ও ৯ নম্বর পদ এখন শূন্য।
২০১৬ সালের ১৯ মার্চ অনুষ্ঠিত দলের ষষ্ঠ জাতীয় কাউন্সিলের সাড়ে চার মাস পর ঘোষিত স্থায়ী কমিটিতে ক্রমানুসারে ছিলেন বেগম খালেদা জিয়া, তারেক রহমান, ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন, ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ, ব্যারিস্টার জমিরুউদ্দিন সরকার, তরিকুল ইসলাম, লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মাহবুবুর রহমান, আ স ম হান্নান শাহ, এম কে আনোয়ার, ব্যারিস্টার রফিকুল ইসলাম মিয়া, মির্জা আব্বাস, গয়েশ্বর চন্দ্র রায়, ড. মঈন খান, নজরুল ইসলাম খান, মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী এবং সালাহ উদ্দিন আহমেদ।
ক্রমানুসারে সালাহ উদ্দিন আহমেদ স্থায়ী কমিটির ১৯ নম্বর সদস্য। তার আগের ১৭ ও ১৮ নম্বর পদ দু’টি শূন্য ছিল। ওই দুই শূন্য পদে সেলিমা রহমান ও ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকুকে অন্তর্ভুক্ত করা হয় ২০১৯ সালে। তার আগে তরিকুল ইসলাম, আ স ম হান্নান শাহ ও এম কে আনোয়ারের মৃত্যুতে স্থায়ী কমিটির ৬, ৮ ও ৯ নম্বর পদ এবং লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মাহবুবুর রহমান রাজনীতি থেকে অবসর নেওয়ায় স্থায়ী কমিটির সাত নম্বর পদটি শূন্য হয়। ২০২১ সালে ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ মারা যাওয়ায় স্থায়ী কমিটির ৪ নম্বর পদটি শূন্য হয়। গুরুতর অসুস্থতার কারণে ২০২০ সাল থেকে সম্পূর্ণ নিষ্ক্রিয় রয়েছেন স্থায়ী কমিটির ১০ নম্বর সদস্য ব্যারিস্টার রফিকুল ইসলাম মিয়া। একই কারণে প্রায় এক বছর যাবত নিষ্ক্রিয় রয়েছেন স্থায়ী কমিটির ৩ নম্বর সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন।
স্থায়ী কমিটির এক নম্বর সদস্য বেগম খালেদা জিয়া গত আড়াই বছর ধরে রাজনীতি থেকে দূরে। করোনা পরিস্থিতির মধ্যে সাময়িক মুক্তি পেলেও দলীয় কর্মকাণ্ডে যুক্ত হতে পারছেন না তিনি। এই মুহূর্তে গুরুতর অসুস্থ অবস্থায় রাজধানীর এভারকেয়ার হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আছেন তিনি।
স্থায়ী কমিটির দুই নম্বর সদস্য তারেক রহমান গত ১৬ বছর ধরে লন্ডনে রয়েছেন। স্কাইপের মাধ্যমে জাতীয় স্থায়ী কমিটির বৈঠকে যুক্ত হন তিনি। তার সভাপতিত্বেই অনুষ্ঠিত হয় বৈঠক।
স্থায়ী কমিটির ১৯ নম্বর সদস্য সালাহ উদ্দিন আহমেদ গত ৯ বছর ধরে ভারতের মেঘালয় রাজ্যের রাজধানী শিলংয়ে আছেন। ২০১৫ সালে বিএনপির অনির্দিষ্টকালের অবরোধ-হরতাল কর্মসূচি চলাকালে তিনি নিখোঁজ হন। বেশ কয়েক মাস পর শিলংয়ে তার হদিস মিললেও অবৈধ অনুপ্রবেশের দায়ে তাকে গ্রেফতার করা হয়। পরবর্তীকালে মামলায় জিতলেও নানা রকম কূটনৈতিক জটিলতায় শিলংয়েই থাকতে হচ্ছে তাকে।
স্থায়ী কমিটির ১৮ নম্বর সদস্য ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু দীর্ঘদিন ধরে দেশের বাইরে রয়েছেন। গত বছর মে মাসে দুর্নীতির মামলার আপিল খারিজ করে নিম্ন আদালতের দেওয়া ৯ বছরের সাজার রায় বহাল রাখেন উচ্চ আদালত। ওই রায়ের পর বিদেশ থেকে আর দেশে ফেরেননি তিনি। এই মুহূর্তে তিনি লন্ডনে অবস্থান করছেন।
স্থায়ী কমিটির ১১ নম্বর সদস্য মির্জা আব্বাস, ১৫ নম্বর সদস্য মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর এবং ১৬ নম্বর সদস্য আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরী ২৮ অক্টোবরের মহাসমাবেশের পরে গ্রেফতার হন। এখন তারা কারাগারে আছেন। আর ১২ নম্বর সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় আছেন আত্মগোপনে।
দলীয় সূত্রমতে, বিএনপির গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে এখন স্থায়ী কমিটির যেসব ভার্চুয়াল বৈঠক হয়, সেখানে তারেক রহমান, ড. মঈন খান, নজরুল ইসলাম খান, সেলিমা রহমান ও সালাহউদ্দিন আহমেদ যুক্ত থাকেন। আত্মগোপনে থাকা গয়েশ্বর চন্দ্র রায় মাঝে মাঝে যুক্ত হন।
অর্থাৎ স্থায়ী কমিটির ১৫ সদস্যের মধ্যে সক্রিয় আছেন মাত্র ১১ জন। ফলে মাঝে-মধ্যেই স্থায়ী কমিটির বৈঠকে কোরাম সংকট দেখা দেয়। এমন বাস্তবতায় শূন্য পদ পূরণ করা প্রয়োজন বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা। মাঝে-মধ্যে দলীয় পরিমণ্ডলে এ নিয়ে আলোচনাও হয়।
অর্থাৎ আন্দোলনের চূড়ান্ত পর্যায়ে এসে বিএনপি এখন চার দলের নেতায় পরিণত হয়েছে। দলটির কেন্দ্রীয় নেতাদের মধ্যে ৯১ জন কারাগারে থাকলেও বাকি পাঁচ শ’ জনের কোনো হদিস। তবে, বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান ডা. এজেড এম জাহিদ হোসেন ও নিতাই রায় চৌধুরী, চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা জয়নুল আবদিন ফারুকসহ কয়েজকজনকে মাঝে-মধ্যে হঠাৎ হঠাৎ দেখা গেলেও বাকিদের দেখা যায় না।
বিএনপির এই পরিস্থিতি সম্পর্কে জানতে চাইলে দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. মঈন খান বাংলাবার্তাকে বলেন, ‘আমরা কী পরিস্থিতির মধ্যে যাচ্ছি, সেটা আপনারা ভালো করেই জানেন। একটা ফ্যাসিস্ট সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন করতে গেলে যে ধরনের কৌশল নিতে হয়, বিএনপি সেটাই নিচ্ছে। এটা অস্বাভাবিক কোনো ঘটনা না।’
বাংলাবার্তা/এআর