
ছবি: সংগৃহীত
সরকার পরিবর্তনের পর দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি নিয়ে গোয়েন্দা ও নিরাপত্তা মহলে গভীর উদ্বেগ দেখা দিয়েছে। বিশেষ করে দেশের বিভিন্ন এলাকায় পুলিশের ওপর ধারাবাহিকভাবে চালানো সহিংস হামলা এবং এর পেছনে থাকা সংগঠিত মহলের ষড়যন্ত্রমূলক তৎপরতা নিয়ে স্পষ্ট তথ্য মিলছে গোয়েন্দা সংস্থার কাছে।
গোয়েন্দা প্রতিবেদনে দাবি করা হয়েছে, আওয়ামী লীগ থেকে বিচ্যুত, আত্মগোপনে থাকা এবং বিতাড়িত একদল নেতাকর্মী গোপনে রাজধানীমুখী হয়ে নানা কৌশলে অস্থিতিশীলতা তৈরির অপচেষ্টায় লিপ্ত। এই দলটির মূল লক্ষ্য হলো—পুলিশ বাহিনীর মনোবল ভেঙে দেওয়া এবং দেশে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির আরও অবনতি ঘটানো।
পুলিশের ওপর হামলার ঘনঘটা
গত সাত মাসে দেশের বিভিন্ন স্থানে পুলিশের ওপর ৫০০টিরও বেশি হামলার ঘটনা ঘটেছে। পুলিশের নিজস্ব পরিসংখ্যান বলছে, শুধু মার্চ মাসেই এসব হামলার সংখ্যা পৌঁছেছে সর্বোচ্চ পর্যায়ে। এই মাসে রাজধানী ঢাকায়ই পুলিশের ওপর ২৩টি হামলার ঘটনা ঘটেছে, যা নিঃসন্দেহে উদ্বেগজনক। এ সময়ে দেশের বিভিন্ন থানায় পুলিশের ওপর হামলার ঘটনায় মোট ৩২২টি মামলা রুজু হয়েছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, এসব হামলার ধরন একই ধরনের—হঠাৎ মব তৈরি করে থানায় বা অভিযানে থাকা পুলিশ সদস্যদের ঘিরে ফেলা, আসামিকে ছিনিয়ে নেওয়া, আহত করা, এমনকি থানাতেই আক্রমণ চালানো।
২৩ মার্চ হবিগঞ্জের লাখাই উপজেলার স্বজনগ্রাম পুলিশ তদন্তকেন্দ্রে ঠিক এমনই একটি ঘটনা ঘটে। আশিক মিয়া নামে এক আসামিকে পুলিশের কাছ থেকে ছিনিয়ে নেওয়া হয়, আহত হন দুই পুলিশ সদস্য। ১৪ জনের নাম উল্লেখ করে মামলা হলেও এখনো আশিক ছাড়া কাউকে গ্রেফতার করা যায়নি।
গোলাম মোস্তফা-যোগসূত্র
গোয়েন্দারা দাবি করছেন, এই পরিকল্পিত হামলাগুলোর পেছনে রয়েছে ছাত্র ও যুব রাজনীতিতে নিষিদ্ধঘোষিত সংগঠনগুলোর সক্রিয় অংশগ্রহণ, যারা এখনো ‘ফ্যাসিস্ট’ কৌশলে মাঠে সক্রিয়। এরই অংশ হিসেবে পাঁচটি মামলার পলাতক আসামি, বিতাড়িত আওয়ামী লীগ নেতা গোলাম মোস্তফার নাম উঠে এসেছে।
১২ মার্চ রাজধানীর মোহাম্মদপুর থেকে গ্রেফতার হওয়া গোলাম মোস্তফাকে তার সহযোগীরা পুলিশের ওপর হামলা চালিয়ে ছিনিয়ে নেয়। এরপর থেকে তিনি ফেরার। এ ঘটনায় মোহাম্মদপুর থানায় মামলা হলেও কাউকে গ্রেফতার করা যায়নি।
ফেসবুক-প্রোপাগান্ডা এবং ‘মব আতঙ্ক’
অপরাধ বিশ্লেষকরা মনে করছেন, শুধু সরাসরি হামলাই নয়, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও পুলিশের মনোবল ভাঙার অপচেষ্টা চালানো হচ্ছে। ফেসবুকে ছড়ানো হচ্ছে গুজব, বিকৃত তথ্য এবং অপপ্রচার। বিশেষ করে যেসব পুলিশ সদস্য বিতর্কিত মামলার তদন্তে সক্রিয়, তাদের বিরুদ্ধে চালানো হচ্ছে টার্গেট প্রোপাগান্ডা।
পুলিশের মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তারা জানান, অভিযানে গিয়ে গ্রেফতার করার পর থানা পর্যন্ত আসা নিয়ে এখন তারা সবচেয়ে বেশি উদ্বিগ্ন। বেশ কয়েকটি থানা ইতোমধ্যে দফায় দফায় হামলার শিকার হয়েছে।
ঢাকায় কর্মরত এক উপ-পরিদর্শক বলেন, "আসামি ধরতে গিয়ে আমরা দুই দিক থেকে বিপদে পড়ি—একদিকে আসামির সংগঠন ও সহযোগীদের হামলার আশঙ্কা, অন্যদিকে ফেসবুকে মিথ্যা প্রচার। এতে আমাদের মনোবলে মারাত্মক প্রভাব পড়ে।”
পুলিশ প্রশাসনের প্রতিক্রিয়া
পুলিশ সদর দপ্তরের এআইজি (মিডিয়া অ্যান্ড পিআর) ইনামুল হক সাগর জানিয়েছেন, “এখন পর্যন্ত যাদের শনাক্ত করা গেছে, তাদের গ্রেফতার করা হয়েছে। যারা পলাতক, তাদের গ্রেফতারে তৎপরতা অব্যাহত রয়েছে। পুলিশের ওপর হামলার বিষয়ে আমরা কোনো ধরনের ছাড় দেব না।”
পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) মোহাম্মদ নুরুল হুদা বলেন, “পুলিশের কাজটাই ঝুঁকিপূর্ণ। তবে এই ঝুঁকির মোকাবেলায় ‘স্ট্রং অ্যাকশন’ দরকার। তা না হলে সুযোগসন্ধানীরা বারবার হামলার সাহস পাবে।”
আরেক সাবেক আইজিপি নূর মোহাম্মদ বলেন, “সাত-আট মাস ধরে চলমান মানসিক চাপ ও হামলার ফলে পুলিশ এখনো পুরোপুরি স্বাভাবিক হয়নি। অনেকেই ভয় আর ট্রমার মধ্যে আছেন।”
‘সাজানো বিশৃঙ্খলার’ নেপথ্য পরিকল্পনা
গোয়েন্দা সংস্থা সূত্রে জানা যায়, পরিকল্পিতভাবে এই হামলাগুলোর মাধ্যমে দেশকে অস্থিতিশীল করা হচ্ছে। তত্ত্বাবধায়ক বা অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতি জনমনে সন্দেহ ও ক্ষোভ তৈরি করাই এর মূল উদ্দেশ্য। এরই মধ্যে সাবেক ছাত্রলীগ ও যুবলীগ নেতাদের নেতৃত্বে সক্রিয় একটি ‘শেডো নেটওয়ার্ক’ গোয়েন্দা নজরদারিতে এসেছে, যারা ‘সিভিলিয়ান প্রোটেস্ট’ এর নামে গোপনে সংঘাত উস্কে দিচ্ছে।
সমাধানে করণীয়
অপরাধ বিশ্লেষকদের মতে, দ্রুত সময়ের মধ্যে কঠোর ব্যবস্থা না নিলে এই হামলা অব্যাহত থাকবে এবং পুলিশ সদস্যদের মধ্যে যে আতঙ্ক বিরাজ করছে তা আরও বেড়ে যাবে।
গণমানুষের আস্থা ফিরে পেতে পুলিশের প্রতি আস্থা পুনঃপ্রতিষ্ঠা এবং সন্ত্রাসে মদদদাতাদের বিচারের আওতায় আনাই এখন সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ বলে মনে করছেন নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা।
বাংলাবার্তা/এমএইচ