
ছবি: সংগৃহীত
চলমান রাজনৈতিক অস্থিরতা, নির্বাচন ঘিরে অনিশ্চয়তা এবং সরকারের নিষ্ক্রিয়তা মোকাবিলায় আবারও সক্রিয় হয়ে উঠেছে বাংলাদেশের প্রধান বিরোধী দল বিএনপি। ২০২5 সালের মধ্যে নিরপেক্ষ, গ্রহণযোগ্য ও সময়োপযোগী জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের দাবিকে আরও শক্তিশালী করতে তারা এবার ‘জাতীয় ঐকমত্য’ গঠনের উদ্যোগ নিয়েছে।
এই উদ্যোগের অংশ হিসেবে বিএনপি দেশের নানা মতাদর্শিক অবস্থানের রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে ধারাবাহিকভাবে বৈঠকে বসার সিদ্ধান্ত নিয়েছে, যার মধ্যে রয়েছে ইসলামপন্থী জামায়াতে ইসলামী, বামধারার দলগুলো, ডান ঘরানার দল ও নাগরিক প্ল্যাটফর্মসমূহ। বিএনপির লক্ষ্য—জাতীয় নির্বাচনের আগে সরকারকে রাজনৈতিকভাবে চাপে রাখা এবং দেশের রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে একটি জোরালো বার্তা দেওয়া যে, বিরোধী রাজনৈতিক মহল নিরপেক্ষ নির্বাচনের জন্য ঐক্যবদ্ধ এবং প্রস্তুত।
গুলশানে নীতিনির্ধারণী বৈঠক
গত বৃহস্পতিবার রাতে গুলশানে বিএনপি চেয়ারপারসনের রাজনৈতিক কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত দলের স্থায়ী কমিটির বৈঠকে এই কৌশলগত সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। বৈঠকে যুক্তরাজ্য থেকে ভার্চুয়ালি যুক্ত ছিলেন দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। উপস্থিত ছিলেন দলের নীতিনির্ধারকরা, যারা নির্বাচনের সময়সূচি, রাজনৈতিক বাস্তবতা, সরকারের ভূমিকা ও নাগরিক প্রতিক্রিয়া নিয়ে ব্যাপক আলোচনা করেন।
দলীয় সূত্রগুলো জানায়, বৈঠকে ফ্যাসিবাদবিরোধী যুগপৎ আন্দোলনের যেসব মিত্র ছিল এবং যেসব দল ২০২৪ সালের বিতর্কিত জাতীয় নির্বাচন বর্জন করেছিল, তাদের সঙ্গেও নতুন করে যোগাযোগ স্থাপন ও সমন্বিত কৌশল গ্রহণের বিষয়ে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।
বৈঠকের সূচনা: ১২ দলীয় জোট ও এলডিপি
আজ শনিবার থেকেই এই রাজনৈতিক সংলাপ শুরু হচ্ছে। প্রাথমিক পর্যায়ে বিএনপি ১২ দলীয় জোট এবং এলডিপির সঙ্গে পৃথক পৃথক বৈঠকে বসবে। পুরো বৈঠক-পর্ব এক থেকে দুই সপ্তাহব্যাপী চলবে বলে জানা গেছে। এরপর অংশগ্রহণকারী দলগুলোর শীর্ষ নেতাদের নিয়ে ঢাকায় একটি সংবাদ সম্মেলন আয়োজনের পরিকল্পনা রয়েছে, যা হতে পারে চলতি এপ্রিলের শেষ দিকে বা মে মাসের শুরুতেই।
এই ধারাবাহিক বৈঠকগুলোর উদ্দেশ্য হলো—ভবিষ্যৎ কর্মপন্থা নির্ধারণ, নির্বাচন ইস্যুতে একটি জাতীয় ঐক্যমতের কাঠামো তৈরি এবং সরকারের উপর রাজনৈতিক ও মনস্তাত্ত্বিক চাপ জারি রাখা। বিএনপি মনে করে, বর্তমান সরকারের ওপর চাপ না বাড়ালে নির্বাচন ২০২৫ সালের জুন তো দূরের কথা, ডিসেম্বরে গিয়েও হতে পারে না।
জামায়াত ইস্যুতে কৌশলী বিএনপি
বিএনপি সব দলের সঙ্গে আনুষ্ঠানিক বৈঠকের পরিকল্পনা করলেও জামায়াতে ইসলামীকে নিয়ে এখনই প্রকাশ্যে বসতে চায় না। দলটি কৌশলগতভাবে জামায়াতের সঙ্গে প্রথমে অনানুষ্ঠানিক আলোচনা শুরু করবে। উল্লেখযোগ্য যে, জামায়াত সম্প্রতি একটি বিবৃতিতে আগামী রমজান মাসের আগেই জাতীয় নির্বাচন চেয়ে সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে, যা বিএনপি ইতিবাচকভাবেই দেখছে।
জাতীয় নাগরিক পার্টির প্রতি অনাগ্রহ
উল্লেখযোগ্য যে, বিএনপি এই জাতীয় সংলাপে জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)কে আমন্ত্রণ জানাবে না। দলের শীর্ষ মহল থেকে স্পষ্ট জানানো হয়েছে, এনসিপির সঙ্গে বৈঠকের কোনো পরিকল্পনা নেই। এর কারণ হিসেবে কিছু অভ্যন্তরীণ মতপার্থক্য এবং রাজনৈতিক অবস্থানের অসামঞ্জস্যের কথা উল্লেখ করা হয়েছে।
ড. ইউনূসের সঙ্গে আলোচনা ও হতাশা
এই বৈঠকের আগে বুধবার বিএনপির একটি প্রতিনিধি দল অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে বৈঠক করে। সেখানে তারা ডিসেম্বরের মধ্যে জাতীয় নির্বাচনের রোডম্যাপ চায় এবং এ বিষয়ে সরকারের অবস্থান জানতে চায়। তবে সেই আলোচনার ফলাফল নিয়ে বিএনপি নেতারা প্রকাশ্যেই হতাশা প্রকাশ করেন।
বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের মুখোমুখি হয়ে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর জানান, “প্রধান উপদেষ্টা কোনো সুনির্দিষ্ট তারিখ আমাদের দেননি। তিনি শুধু বলেছেন, ডিসেম্বর থেকে জুনের মধ্যে তিনি নির্বাচন শেষ করতে চান।”
এ বক্তব্য থেকেই বোঝা যায়, বিএনপির দাবির সঙ্গে সরকারের অবস্থান এখনো অনেক দূরে। দলটির নীতিনির্ধারকদের মতে, সরকারের অভ্যন্তরে একটি মহল নির্বাচন বিলম্বিত করতে চায় এবং তারাই প্রকৃত অর্থে সংকট তৈরির চেষ্টা করছে।
নির্বাচনী দাবিতে নতুন কৌশল
বিএনপির নীতিনির্ধারকেরা মনে করছেন, সরকারকে সরাসরি হটানোর মতো পরিস্থিতি এখনো তৈরি হয়নি। তারা বিশ্বাস করেন, এই সরকারই গণ-আন্দোলনের ফল, এবং এই সরকারকে সহায়তা করেই একটি অবাধ, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের মাধ্যমে পরিবর্তনের সুযোগ সৃষ্টি করতে হবে।
বিএনপির এক শীর্ষ নেতা বলেন, “আমরা কোনো বিশৃঙ্খলা চাই না, কিন্তু সরকার যদি রাজনৈতিক দলগুলোর যৌক্তিক দাবিকে পাত্তা না দেয়, তাহলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে পারে।” সে কারণেই বিএনপি একটি জাতীয় ঐকমত্যের প্ল্যাটফর্ম তৈরি করে নির্বাচনের দাবিকে সর্বজনীন রূপ দিতে চায়।
সার্বিকভাবে বিএনপির এই নতুন উদ্যোগ বাংলাদেশের রাজনীতিতে একটি নতুন গতিপথ সূচিত করতে পারে। নির্বাচনের সময়সীমা, রোডম্যাপ ও গ্রহণযোগ্যতার প্রশ্নে সরকার ও বিরোধীদের মধ্যে যে ব্যবধান তা পূরণ করতে এই জাতীয় ঐক্য কতটা কার্যকর হবে, তা এখন সময়ই বলে দেবে। তবে একটি বিষয় পরিষ্কার—বিএনপি আর কেবল সরকারবিরোধী আন্দোলনে সীমাবদ্ধ থাকতে চাইছে না, বরং একটি সাংবিধানিক ও রাজনৈতিক সংকট সমাধানে জাতীয় উদ্যোগ গ্রহণে নেতৃত্ব দিতে চায়।
বাংলাবার্তা/এমএইচ