
ছবি: সংগৃহীত
চব্বিশ সালের গণ-অভ্যুত্থান ছিল রাষ্ট্রব্যবস্থার গঠনমূলক রূপান্তরের জন্য—একটি দলকে সরিয়ে আরেকটি দলকে ক্ষমতায় বসানোর ষড়যন্ত্র নয়। এমন মন্তব্য করে জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম বলেন, “এই আন্দোলনের মূল ভিত্তি ছিল মৌলিক মানবাধিকার, আইন ও বিচার সংস্কার এবং একটি বাস্তব গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার বিকাশ।”
শনিবার (১৯ এপ্রিল) সকালে সংসদ ভবনের এলডি হলে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে অনুষ্ঠিত এক গুরুত্বপূর্ণ বৈঠকে সূচনা বক্তব্যে তিনি এসব কথা বলেন। এই বৈঠকে এনসিপির একটি উচ্চপর্যায়ের প্রতিনিধি দল উপস্থিত ছিল, যারা রাষ্ট্রের ভবিষ্যৎ কাঠামো ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা নিয়ে তাদের প্রস্তাবনা উপস্থাপন করেন।
গণ-অভ্যুত্থানের লক্ষ্য ছিল রাজনৈতিক সংস্কার, দলীয় মোচন নয়
নাহিদ ইসলামের বক্তব্যে স্পষ্ট হয় যে, সদ্যসমাপ্ত গণ-আন্দোলনের লক্ষ্য ছিল শাসকদলের পরিবর্তন নয়, বরং গোড়ায় পরিবর্তন এনে একটি দায়বদ্ধ ও জনবান্ধব শাসনব্যবস্থা কায়েম করা। তিনি বলেন, “আমরা দল পাল্টানোর রাজনীতি করি না, জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠার রাজনীতি করি। যে অভ্যুত্থান দেখেছে এই জাতি, তা ছিল একটি বিকল্প রাজনৈতিক দর্শনের প্রতিফলন।”
তিনি আরো বলেন, “আমরা এমন একটি সংবিধান চাই, যেখানে ব্যক্তিকেন্দ্রিক ক্ষমতা নয়, প্রাতিষ্ঠানিক ভারসাম্য থাকবে। যেখানে নির্বাচন কমিশন স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারবে, বিচার বিভাগ হবে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত, আর সংসদ হবে কার্যকর।”
“জুলাই সনদ” তুলে ধরার আহ্বান
বৈঠকে এনসিপির পক্ষ থেকে একাধিকবার উচ্চারণ করা হয় “জুলাই সনদ”-এর কথা। নাহিদ বলেন, “আমরা চাই এই সনদ জাতির সামনে স্পষ্টভাবে উপস্থাপন হোক। এই সনদে রয়েছে আমাদের রাজনৈতিক অঙ্গীকার, যা নতুন বাংলাদেশের ভিত্তি রচনা করবে।”
“এটি শুধু একটি দল বা জোটের বিষয় নয়, এটা একটি জাতীয় প্রতিশ্রুতি। আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতির যে দুর্বলতা—স্বৈরতন্ত্র, দলীয় দুর্নীতি, ক্ষমতার অপব্যবহার—তা থেকে বেরিয়ে আসতে হলে এই সনদের বাস্তবায়ন জরুরি,”—যোগ করেন তিনি।
স্বৈরতন্ত্র ও ফ্যাসিবাদের রাস্তাগুলো চিরতরে বন্ধ করতে চায় এনসিপি
নাহিদ ইসলাম বলেন, “আমরা আরেকটি স্বৈরাচার কিংবা ফ্যাসিবাদকে এই দেশে জায়গা দিতে পারি না। ইতিহাস আমাদের বারবার শিখিয়েছে, যখন রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলো দুর্বল থাকে, তখনই স্বৈরাচার মাথা তোলে।”
তিনি আরও বলেন, “আমরা এই পথ আগেই দেখেছি। আমরা আর ফিরে যেতে চাই না। তাই আমাদের পথ একটাই—একটি স্বাধীন, শক্তিশালী, এবং গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ গড়া।”
প্রতিনিধি দলের সদস্যরা কী বললেন?
এনসিপির প্রতিনিধি দলে আরও ছিলেন সদস্য সচিব আখতার হোসেন, মুখ্য সমন্বয়ক নাসিরউদ্দিন পাটোয়ারী, যুগ্ম আহ্বায়ক সরোয়ার তুষার, মুখ্য সংগঠক হাসনাত আব্দুল্লাহ, জ্যেষ্ঠ যুগ্ম আহ্বায়ক সামান্তা শারমিনসহ আরও দুজন। তাঁরা বৈঠকে বিস্তারিতভাবে রাজনৈতিক সংস্কার প্রক্রিয়ার রূপরেখা তুলে ধরেন এবং কমিশনের সদস্যদের সঙ্গে খোলামেলা আলোচনা করেন।
আখতার হোসেন বলেন, “আমরা যে ভবিষ্যৎ নির্মাণ করতে চাই, তার ভিত্তি হলো স্বচ্ছতা, জবাবদিহি ও জনগণের ওপর রাষ্ট্রের পূর্ণ নির্ভরতা।”
ঐকমত্য গঠনের প্রক্রিয়ায় নতুন মাত্রা
জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে ধারাবাহিক বৈঠকের অংশ হিসেবে এই আলোচনাটি রাজনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা। গত ১৭ এপ্রিল বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার জমির উদ্দিন সরকারের নেতৃত্বে পাঁচ সদস্যের প্রতিনিধি দলও এই কমিশনের সঙ্গে বৈঠক করে নিজেদের প্রস্তাবনা উপস্থাপন করে।
বিশ্লেষকরা মনে করছেন, গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার ও সাংবিধানিক কাঠামোর সংস্কারে এই ধরণের সমন্বিত উদ্যোগ জাতীয় সংলাপের একটি শক্ত ভিত গড়তে পারে।
বাংলাবার্তা/এমএইচ