
ছবি: সংগৃহীত
বাংলাদেশের রাজনীতিতে ফের উত্তাপ ছড়িয়েছে ‘প্রশাসনের পক্ষপাত’ নিয়ে পাল্টাপাল্টি অভিযোগকে কেন্দ্র করে। নির্বাচনকে সামনে রেখে এ বিতর্ক ঘনীভূত হচ্ছে, বিশেষ করে জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) ও বিএনপির মধ্যে। ক্ষমতাসীন অন্তর্বর্তী সরকারের অংশীদার এনসিপি সম্প্রতি অভিযোগ তুলেছে, দেশের প্রশাসন এখন বিএনপির পক্ষে কাজ করছে। এ বক্তব্যের তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছে বিএনপি, যাদের মতে— প্রশাসনের সঙ্গে বরং বৈষম্যবিরোধীদের সখ্যতা সবচেয়ে গভীর।
যুক্তরাষ্ট্রের কর্মকর্তাদের সঙ্গে সাক্ষাতের পর নাহিদের বিস্ফোরক মন্তব্য
গত বুধবার ঢাকায় সফররত যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের উপসহকারী দুজন কর্মকর্তার সঙ্গে বৈঠকের পরই এনসিপির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম এই বিতর্কিত মন্তব্য করেন। তিনি বলেন, “বাংলাদেশের অনেক জায়গায় প্রশাসন বিএনপির পক্ষে কাজ করছে। এমন প্রশাসনের অধীনে নির্বাচন কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না।”
নাহিদ ইসলামের এই বক্তব্য রাজনৈতিক অঙ্গনে ব্যাপক প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করেছে। সামাজিক মাধ্যমেও বিষয়টি নিয়ে প্রবল আলোচনা চলছে। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, এই বক্তব্য নির্বাচনকে ঘিরে বিরাজমান অনিশ্চয়তা ও দ্বন্দ্বকে আরও উসকে দিচ্ছে।
প্রশাসনের নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন— কেন এখন?
নাহিদ ইসলাম নিজে কিছুদিন আগেই অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা ছিলেন। সেই পদ থেকে পদত্যাগ করে এখন তিনি দলের নেতৃত্বে আছেন। ফলে তার এমন মন্তব্যকে অনেকেই দেখছেন ‘বিতর্কিত ও সময়োপযোগী রাজনৈতিক কৌশল’ হিসেবে। বিশেষ করে যখন এনসিপি এবং বিএনপি সংস্কার ও নির্বাচন নিয়ে দুই ভিন্নমুখী অবস্থান গ্রহণ করেছে। বিএনপি সংস্কার শেষ করে দ্রুত নির্বাচনের পক্ষে, অপরদিকে এনসিপি বলছে— মৌলিক সংস্কার ছাড়া নির্বাচন গ্রহণযোগ্য হবে না।
নাহিদের বক্তব্য অনুসারে, প্রশাসনের মাঠপর্যায়ে একধরনের পৃষ্ঠপোষকতা বিএনপি পেয়ে যাচ্ছে। তিনি দাবি করেন, “চাঁদাবাজির মতো কার্যক্রমে প্রশাসন নিশ্চুপ ভূমিকা পালন করছে, যা ইঙ্গিত দেয়— তারা বিএনপির প্রতি নমনীয়।” তার মতে, একটি ‘লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড’ নিশ্চিত করতে হলে প্রশাসনের মধ্যে নিরপেক্ষতা নিশ্চিত করতে হবে।
পাল্টা অভিযোগ: প্রশাসন বৈষম্যবিরোধীদের সঙ্গেই
এ অভিযোগের জবাবে বিএনপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেন, “নাহিদ ইসলাম যা বলেছেন, তা নিছক রাজনৈতিক বাগাড়ম্বর।” তিনি স্পষ্ট করেন, “বাংলাদেশের প্রশাসন বিএনপির নয়। বরং যারা বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের নামে সরকারের আশীর্বাদে সরকারে গেছেন, তারাই প্রশাসনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বজায় রেখেছে।”
রিজভী আরও বলেন, “যারা সরকারে থাকে, প্রশাসন সাধারণত তাদের পক্ষে কাজ করে। বাংলাদেশের প্রশাসন যদি কারও হয়, তবে তা ইউনূস প্রশাসন। আজ যারা বলছেন প্রশাসন বিএনপির, তারাই বিগত বছরগুলোতে প্রশাসনকে ব্যবহার করে নিজেদের স্বার্থসিদ্ধি করেছেন।”
সাবেক সচিবও বললেন— এটা রাজনৈতিক রেটরিক
বিএনপির বক্তব্যকে সমর্থন দিয়ে সাবেক সচিব আবু আলম শহীদ খান বলেন, “নাহিদ ইসলামের বক্তব্য নিছক রাজনৈতিক। তিনি এখন দল করছেন, তাই এমন কিছু বলতেই পারেন। তবে বাস্তবে তার দল অন্তর্বর্তী সরকারে অংশ নিয়েছে, পদ-পদবি নিয়েছে। এখন প্রশাসন নিয়ে অভিযোগ করার নৈতিকতা তারা হারিয়েছে।”
তিনি বলেন, “সরকার এখনও বদলি, পদোন্নতি, পদায়ন করছে। এসব করছেই বর্তমান সরকার। এটা বিএনপির সরকার নয়। সুতরাং, প্রশাসন নিয়ে বিএনপির প্রতি পক্ষপাতিত্বের অভিযোগ ভিত্তিহীন।” তিনি এটিকে নির্বাচনের পটভূমিতে বিতর্ক সৃষ্টি করার একটি পরিকল্পিত প্রচেষ্টা বলেও মনে করেন।
এনসিপি নেতাদের যুক্তি: প্রশাসন ভবিষ্যতের সম্ভাব্য শক্তির দিকেই ঝুঁকছে
এনসিপির সিনিয়র যুগ্ম আহ্বায়ক আরিফুল ইসলাম আদীব বলেন, “বাংলাদেশের আমলাতন্ত্র সবসময় ভবিষ্যতের সম্ভাব্য শক্তির সঙ্গে নিজেকে মানিয়ে নেয়। আজ যদি তাদের ধারণা হয়— বিএনপি শিগগির ক্ষমতায় আসবে, তারা বিএনপির সঙ্গে দর কষাকষি শুরু করে দেয়।”
তিনি আরও বলেন, “বর্তমান নির্বাচন কমিশন এমনভাবে কাজ করছে যেন এটি বিএনপি সুপারিশ করেছিল। অন্য দলগুলোর সঙ্গে ‘বিমাতাসুলভ’ আচরণ করছে। পুলিশ প্রশাসনও থানা পর্যায়ে বিএনপিকে প্রাধান্য দিচ্ছে।”
আদীবের মতে, প্রশাসনের পক্ষপাতিত্বের এই ধারা স্পষ্ট, এবং এটি নির্বাচনের আগে রাজনৈতিক ভারসাম্য নষ্ট করতে পারে।
উপদেষ্টারা কি আদৌ প্রভাব ফেলতে পারছেন?
এ বিতর্কে আরেকটি প্রশ্ন উঠেছে— অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টারা আদৌ প্রশাসনে কতটা প্রভাব ফেলতে পারছেন? আরিফুল ইসলাম আদীব বলেন, “সরকারে বহু স্তর আছে— মন্ত্রী, আমলা, উপদেষ্টা, প্রেশার গ্রুপ। তাই উপদেষ্টারা অনেক কিছু বলতে পারেন, কিন্তু সবকিছু বাস্তবায়ন করতে পারেন না। সরকারে থেকে ক্ষমতা প্রয়োগ করা সবসময় সম্ভব হয় না।”
সরকারের নীরবতা
নাহিদ ইসলামের অভিযোগের ব্যাপারে সরকারঘনিষ্ঠ উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান ও আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়ার সঙ্গে যোগাযোগ করলেও কোনো মন্তব্য পাওয়া যায়নি।
নির্বাচন সামনে, বিতর্ক বাড়ছেই
নির্বাচন যত ঘনিয়ে আসছে, ততই বাড়ছে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে প্রশাসনকে ঘিরে সন্দেহ, অসন্তোষ ও অভিযোগের তীব্রতা। একপক্ষ প্রশাসনকে নিজেদের প্রতিপক্ষ ভাবছে, আরেকপক্ষ বলছে— প্রশাসন আসলে তাদের পক্ষেই কাজ করছে না।
প্রশাসন আদৌ নিরপেক্ষ কিনা, বা কে কাকে সুবিধা দিচ্ছে— সে বিতর্ক এখন রাজনৈতিক বাস্তবতার অংশ হয়ে উঠেছে। তবে একথা পরিষ্কার, নির্বাচনকে ঘিরে এই বিতর্ক আরও বহুদিন জারি থাকবে।
বাংলাবার্তা/এমএইচ