
ছবি: সংগৃহীত
দীর্ঘ সাড়ে ১৫ বছরের একচ্ছত্র শাসনের পর ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট ঢাকার রাজপথে গণ-অভ্যুত্থানের মুখে ক্ষমতাচ্যুত হয় আওয়ামী লীগ। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশ ছেড়ে পালিয়ে ভারতে আশ্রয় নেন, একে একে দেশ ছাড়েন মন্ত্রিসভার অনেক সদস্য, দলের কেন্দ্রীয় ও আঞ্চলিক নেতারা। জনগণের দুর্বার প্রতিরোধে পতন ঘটে এক ‘নব্য ফ্যাসিস্ট’ শাসনের। একইসঙ্গে দেশজুড়ে শুরু হয় আওয়ামী লীগ ও তার ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগকে নিষিদ্ধ ঘোষণার জোর দাবি। সেই দাবির পরিপ্রেক্ষিতেই একই বছরের ২৩ অক্টোবর ছাত্রলীগকে নিষিদ্ধ করে প্রজ্ঞাপন জারি করে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। কিন্তু অবাক করা বিষয় হলো, আওয়ামী লীগের নিষিদ্ধকরণ এখনও ঝুলে আছে—যেন একটি অদৃশ্য শক্তির ইচ্ছাতেই থেমে আছে বিচার ও শুদ্ধি অভিযানের ধারা।
হঠাৎ করেই রাজপথে ফের সরব আওয়ামী লীগ: মাস্টারপ্ল্যানের অংশ?
গত কয়েক সপ্তাহে রাজধানী ঢাকা ও দেশের নানা জায়গায় একের পর এক ঝটিকা মিছিল করছে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা। সর্বশেষ গত শুক্রবার রাজধানীর উত্তরখানে একটি ঝটিকা মিছিলের নেতৃত্ব দেন উত্তরখান ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আতিকুর রহমান মিলন। মিছিলে সরাসরি অংশগ্রহণ করেন আওয়ামী লীগ ও তাদের অঙ্গসংগঠনের সদস্যরা। অথচ এই দলটি রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় দীর্ঘকাল যাবৎ মানবাধিকার লঙ্ঘন, দুর্নীতি, এবং বিচারবহির্ভূত দমন-পীড়নের জন্য দায়ী ছিল বলে আন্তর্জাতিক মহলেও আলোচনা হয়েছে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, এই হঠাৎ সক্রিয়তা কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। বরং এটি একটি সুপরিকল্পিত মাস্টারপ্ল্যানের অংশ, যার পেছনে কাজ করছে দেশি-বিদেশি নানা চক্র। যার মধ্যে ভারতীয় প্রশাসন ও বাংলাদেশের আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর একাংশের ভূমিকাকে সন্দেহের চোখে দেখা হচ্ছে।
প্রশাসনের ‘সবুজ সংকেত’ ছাড়া এতদূর সম্ভব?
বিশ্লেষকদের প্রশ্ন—যে দলটি কয়েক মাস আগেও গণহত্যা, দুর্নীতি ও দমননীতির প্রতীক ছিল, সেই দল কীভাবে পুলিশি নজরদারির মধ্যেও মিছিল করতে পারছে? সরাসরি নিষিদ্ধ না হলেও ছাত্রলীগের মতো ভয়ঙ্কর সংগঠন যদি বন্ধ হয়, তাহলে মূল রাজনৈতিক দলটির এতটা স্বাধীনভাবে সংগঠিত হওয়ার সুযোগ কে দিচ্ছে?
সাবেক সামরিক কর্মকর্তা ও বর্তমান স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী গত শনিবার এক পরিদর্শনকালে পুলিশকে নির্দেশ দেন যেন আওয়ামী লীগ কোনোভাবেই মিছিল করতে না পারে। একইসঙ্গে জানান, পুলিশ ইতোমধ্যে এই নিষিদ্ধ রাজনীতির দায়ে ছয়জনকে গ্রেপ্তার করেছে। তবে প্রশ্ন উঠেছে, এর আগে কেন পুলিশ নিষ্ক্রিয় ছিল?
ভারতীয় ভূমিকা: বন্ধুর ছায়ায় পুনর্বাসনের নকশা
রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞরা সরাসরি ইঙ্গিত দিচ্ছেন প্রতিবেশী ভারত সরকারের প্রতি। আওয়ামী লীগের ইতিহাসঘেঁটে দেখা যায়, ২০০৯ সাল থেকে ২০২4 সাল পর্যন্ত ভারত-সমর্থিত কূটনৈতিক, অর্থনৈতিক ও নিরাপত্তা সহযোগিতা ছিল শেখ হাসিনার সরকারের অন্যতম ভিত্তি। শেখ হাসিনার ক্ষমতাচ্যুতির পর ভারত হঠাৎ করে সম্পূর্ণ নীরব হয়ে যায়, অথচ সে সময় বাংলাদেশে গণহত্যা, ইন্টারনেট শাটডাউন, বিরোধীদলীয় নেতাকর্মীদের গুম—এসব নিয়েও তাদের কোনো বিবৃতি পাওয়া যায়নি।
সম্প্রতি ভারতীয় মিডিয়া ও নীতিনির্ধারক মহলে প্রকাশিত কিছু নথিতে দেখা গেছে, বাংলাদেশে স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনার নামে একটি ‘নিয়ন্ত্রিত গণতন্ত্র’ কৌশল বাস্তবায়নের চেষ্টা করছে দিল্লি। সেখানে বলা হচ্ছে, ‘আওয়ামী লীগকে পুরোপুরি নিষিদ্ধ করলে বাংলাদেশে ইসলামপন্থী রাজনৈতিক শক্তির উত্থান ঘটবে’। ফলে ওই দলটিকে রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় অন্তর্ভুক্ত রাখার সুপারিশ দিচ্ছেন দিল্লির একাধিক স্ট্র্যাটেজিক থিঙ্কট্যাঙ্ক।
ভয়াবহ ভবিষ্যৎ: রাজনীতিতে পুনঃপ্রতিষ্ঠার দুঃস্বপ্ন
বিশ্লেষক মাসুদ কামাল বলেন, “আমি আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করার পক্ষে নই, তবে যারা এই দলে থেকে ক্ষমতা অপব্যবহার করেছে তাদের বিচারের আওতায় আনা আবশ্যক। না হলে এই অপরাধের পুনরাবৃত্তি ঘটতে বাধ্য।” অন্যদিকে এনডিএম চেয়ারম্যান ববি হাজ্জাজ বলছেন, “এই ফ্যাসিস্ট দলটিকে নিষিদ্ধ করতেই হবে। তা না হলে ভবিষ্যতে বাংলাদেশ আবার এক স্বৈরশাসনের ফাঁদে পড়বে।”
তিনি আরও বলেন, “আওয়ামী লীগের পেছনে দেশি-বিদেশি শক্তির যে মাস্টারপ্ল্যান রয়েছে তা যদি সফল হয়, তাহলে শুধু রাজনীতি নয়, বরং বিচারিক প্রক্রিয়াও প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়বে। তখন ‘জুলাই হত্যাকাণ্ড’-এর মতো ঘটনার বিচারও রাজনৈতিক মামলার মতো আর্কাইভে আটকে যাবে।”
অর্থের উৎস ও সংগঠনের বিস্তার
নিরাপত্তা সূত্রে জানা যায়, বর্তমানে ইউরোপ ও মধ্যপ্রাচ্য থেকে বিপুল পরিমাণ কালোটাকা পাচার হয়ে আসছে বাংলাদেশে, যেগুলো ব্যবহার করা হচ্ছে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের পুনরায় সংগঠিত করতে। বিভিন্ন মহল বলছে, এই টাকা এসেছে আওয়ামীপন্থী প্রবাসী নেতাদের মাধ্যমে, যাঁরা বিভিন্ন দেশে ব্যবসার আড়ালে দলের অর্থ যোগান দিয়ে যাচ্ছেন। ছাত্রলীগসহ নিষিদ্ধ সংগঠনের সদস্যরা সেই টাকা ব্যবহার করে স্থানীয় পর্যায়ে আবারও সংগঠন গড়ে তুলছে।
এছাড়া আওয়ামীপন্থী কয়েকজন সাবেক আমলাও ভূমিকা রাখছেন প্রশাসনের মধ্যে থেকে দলটির পুনর্বাসনে। কিছু জেলা প্রশাসক ও পুলিশ কর্মকর্তা এখনো দলটির প্রতি সহানুভূতিশীল অবস্থানে থেকে ‘নিরব সহায়তা’ দিচ্ছেন বলে অভিযোগ উঠেছে।
বিভাজনের রাজনীতি ও ষড়যন্ত্রের নতুন ধারা
একটি বড় ধরনের কৌশলের অংশ হিসেবে বর্তমানে আওয়ামী এজেন্টরা ছত্রিশে জুলাইয়ের গণ-আন্দোলনের বিভিন্ন শক্তির মধ্যে বিভেদ তৈরি করছে। বিশেষ করে ছাত্র আন্দোলন ও বিএনপি-জামায়াতের মধ্যকার দূরত্ব সৃষ্টি করার জন্য গোপনে অপপ্রচার চালানো হচ্ছে। এছাড়া স্থানীয় পর্যায়ে বিএনপি ও জামায়াতের নেতাদের সঙ্গে সমঝোতায় গিয়ে ছোট ছোট সমাবেশে অংশ নিচ্ছে আ.লীগ নেতারা।
ফলে অনেক স্থানে মানুষের মধ্যে বিভ্রান্তি ও অবিশ্বাস ছড়াচ্ছে। এতে নতুন করে সহিংসতা ও সংঘাতের সম্ভাবনা তৈরি হচ্ছে, যা দেশের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতাকে চরমভাবে ব্যাহত করতে পারে বলে মনে করেন বিশ্লেষকেরা।
আওয়ামী লীগের মাঠে ফেরার চিত্র যতটা না স্বতঃস্ফূর্ত, তার চেয়ে অনেক বেশি সুপরিকল্পিত। দেশের অভ্যন্তরে প্রশাসনিক শক্তির ছত্রচ্ছায়া ও বাইরের শক্তির কূটকৌশলে একটি ব্যর্থ, বিতাড়িত, ফ্যাসিস্ট রাজনৈতিক দল আবারও ফিরে আসার মরিয়া প্রচেষ্টা চালাচ্ছে। এখন সময় সতর্ক হওয়ার। দলটি যদি নিষিদ্ধ না হয়, আর এই মাস্টারপ্ল্যান বাস্তবায়নে বাঁধা না দেওয়া হয়, তাহলে আবারও এক অন্ধকার সময়ের দিকে এগিয়ে যাবে বাংলাদেশ।
বাংলাবার্তা/এমএইচ