
ছবি: সংগৃহীত
বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে একটি গঠনমূলক ও গণতান্ত্রিক ভবিষ্যৎ গড়তে হলে সকল দলকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে—এমন বক্তব্য দিয়ে জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম রোববার (২০ এপ্রিল) বলেছেন, “এই দেশে আমরা গণতান্ত্রিক পরিবেশে শ্বাস নিচ্ছি। মতপ্রকাশের স্বাধীনতা ফিরেছে। কিন্তু সেই স্বস্তির বাতাসে যেন কোনোভাবে আবারও ফ্যাসিবাদী শক্তির অনুপ্রবেশ না ঘটে, সে জন্য আমরা সবাই ঐক্যবদ্ধ।”
রাজধানীতে অনুষ্ঠিত একটি আন্তঃদলীয় আলোচনা সভায় তিনি এসব কথা বলেন। এই আলোচনায় জাতীয় নাগরিক পার্টির সঙ্গে অংশ নেয় ইসলামপন্থী রাজনৈতিক দল খেলাফত মজলিস। আলোচনায় বর্তমান রাজনৈতিক বাস্তবতায় দুই দল ভবিষ্যৎ কর্মপরিকল্পনা এবং পারস্পরিক সমঝোতার ভিত্তিতে জাতীয় রাজনীতিতে একটি বৃহৎ ঐক্য গঠনের আহ্বান জানায়।
ফ্যাসিবাদবিরোধী ঐক্যের পটভূমি
নাহিদ ইসলাম তার বক্তব্যে স্মরণ করিয়ে দেন, “মাত্র কয়েক মাস আগে, ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট তারিখে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকার ছাত্র-জনতার সম্মিলিত গণআন্দোলনের মুখে পতনের মধ্য দিয়ে ক্ষমতা ছাড়ে। দেশের বিভিন্ন জায়গায় চলমান তীব্র গণজাগরণ এবং রাজধানীমুখী অভ্যুত্থানের প্রেক্ষিতে তৎকালীন প্রশাসন ভেঙে পড়ে।”
তিনি বলেন, “সেই সময়ের আন্দোলন ছিল মূলত ফ্যাসিবাদ ও একনায়কতন্ত্রের বিরুদ্ধে। আজ আমরা গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার করেছি। কিন্তু স্বাধীন মতপ্রকাশের এই বিজয়কে টিকিয়ে রাখতে হলে, ভবিষ্যতে যেন পুরনো দানবেরা ফিরে না আসে, সেদিকে নজর রাখতে হবে।”
তিনি উল্লেখ করেন, “ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর আওয়ামী লীগ অনেকদিন রাজনৈতিক নিষ্ক্রিয়তায় ছিল। তাদের শীর্ষ ও স্থানীয় নেতারা আত্মগোপনে থাকলেও এখন বিভিন্ন এলাকায় তারা আবার রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড শুরু করেছে। রাজধানীতে, জেলা শহরগুলোতে দেখা যাচ্ছে হঠাৎ করে মিছিল, ছোট ছোট সমাবেশ। এটি আশঙ্কার বিষয়, কারণ যারা এক সময় মানুষের বাকস্বাধীনতা কেড়ে নিয়েছিল, গণতন্ত্রকে জিম্মি করেছিল, তারা যেন আর কখনও রাজনীতিতে প্রভাব বিস্তার করতে না পারে, সেটিই নিশ্চিত করতে হবে।”
ঐক্যমতের ভিত্তিতে যৌথ কর্মসূচি
আলোচনার মূল বিষয় ছিল রাজনৈতিক সংস্কার, গণতান্ত্রিক রূপান্তর এবং নির্বাচনের পূর্বশর্ত হিসেবে একটি মৌলিক সংস্কার প্রক্রিয়া। এ নিয়ে দুই দলের মধ্যে আট দফা বিষয়ে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, জানালেন নাহিদ ইসলাম।
তিনি বলেন, “আমরা খেলাফত মজলিসের সঙ্গে আলোচনা করেছি এবং তারা আমাদের আট দফা প্রস্তাবে নীতিগত ঐকমত্য প্রকাশ করেছে। এই আট দফার মধ্যে রয়েছে—মৌলিক সংস্কার সম্পন্ন করে একটি গ্রহণযোগ্য জাতীয় নির্বাচন আয়োজন, শেখ হাসিনা এবং তাঁর সরকারের বিরুদ্ধে মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগে বিচার কার্যক্রম শুরু, আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক নিবন্ধন স্থগিত রাখা, জুলাইয়ের শহীদদের সাংবিধানিক স্বীকৃতি প্রদান, ও একটি ঐক্যবদ্ধ অন্তর্বর্তী সরকার গঠন ইত্যাদি।”
খেলাফত মজলিসের অবস্থান
আলোচনায় উপস্থিত ছিলেন খেলাফত মজলিসের মহাসচিব ড. আহমদ আব্দুল কাদের। তিনি বলেন, “আমরা মনে করি, গণতন্ত্র ও ধর্মীয় মূল্যবোধ রক্ষার জন্য আমাদের ঐক্যবদ্ধ হওয়া জরুরি। এনসিপির আট দফা বাস্তবসম্মত ও ন্যায়সঙ্গত। তাই আমরা এই ভিত্তিতে ঐকমত্যে পৌঁছেছি।”
তিনি আরও বলেন, “ঐকমত্যের ভিত্তিতে আমরা ‘জুলাই সনদ’ নামে একটি রাজনৈতিক দলিল প্রণয়ন করব, যাতে মৌলিক সংস্কার নিশ্চিত হওয়ার পর একটি সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন আয়োজনের রূপরেখা থাকবে।”
ভবিষ্যৎ রাজনৈতিক রূপরেখা
নাহিদ ইসলাম ও ড. কাদের উভয়েই জানিয়েছেন, রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে এই ধরনের আন্তঃদলীয় সংলাপ চলমান থাকবে এবং শিগগিরই আরও কয়েকটি রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আলোচনা করে একটি জাতীয় ঐক্য ফ্রন্ট গঠনের পরিকল্পনা রয়েছে। তাদের ভাষায়, “গণতন্ত্র ও রাষ্ট্রীয় সংস্কারে বিশ্বাসী সকল শক্তিকে একসঙ্গে পথ হাঁটতে হবে। শুধুমাত্র ক্ষমতা পরিবর্তন নয়, রাষ্ট্রযন্ত্রের চরিত্র বদলানোই আমাদের লক্ষ্য।”
ফ্যাসিবাদ রুখতে রাজনৈতিক ঐক্যই প্রধান অবলম্বন
নাহিদ ইসলাম শেষ পর্যন্ত বলেন, “আমরা অতীতে দেখেছি কীভাবে একটি দল রাষ্ট্রযন্ত্রকে নিজেদের দাসে পরিণত করেছিল। সেই ভয়াল সময় যেন আর ফিরে না আসে। জনগণের রায়ই হবে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত, তবে তার আগে আমাদের দরকার গণতান্ত্রিক কাঠামোর পূর্ণ সংস্কার। আর এই লড়াইয়ে, সব মত ও পথের রাজনৈতিক শক্তিকে সঙ্গে নিয়ে আমরা ঐক্যবদ্ধ থাকব।”
এই রাজনৈতিক সংলাপ শুধু একটি দিনের আলোচনায় সীমাবদ্ধ নয়—বরং এর মধ্য দিয়ে স্পষ্ট হয়ে উঠছে, বাংলাদেশ এখন এক নতুন রাজনৈতিক বাস্তবতার দিকে এগোচ্ছে, যেখানে পুরনো ক্ষমতার অপব্যবহারের ইতিহাস ভুলে নয়, বরং সেই ইতিহাসের বিচারের ভিত্তিতে এক নতুন যুগের সূচনা করতে চায় বর্তমান রাজনৈতিক নেতৃত্ব।
বাংলাবার্তা/এমএইচ