
ছবি: সংগৃহীত
বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে নতুন করে চাঞ্চল্য ছড়িয়েছে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীকে ঘিরে। ফ্যাসিস্ট সরকারের পতনের পর আট মাস পেরিয়ে গেলেও দলটির নির্বাচনি নিবন্ধন এবং ঐতিহ্যবাহী প্রতীক ‘দাঁড়িপাল্লা’ ফিরে পাওয়ার বিষয়ে এখনো কোনো চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত দেয়নি দেশের সর্বোচ্চ আদালত। সুপ্রিমকোর্টের আপিল বিভাগে ঝুলে থাকা মামলাগুলোর দিকে তাই এখন তাকিয়ে আছেন দলটির নেতাকর্মী থেকে শুরু করে পর্যবেক্ষকরাও।
আট মাস পরও নিষ্পত্তি হয়নি গুরুত্বপূর্ণ দুটি মামলা
২০২৪ সালের ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার ফ্যাসিবাদী সরকার গণ-অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতাচ্যুত হয়। এরপর অনেক রাজনৈতিক বন্দির মুক্তি মিললেও জামায়াতের ভারপ্রাপ্ত সেক্রেটারি জেনারেল এটিএম আজহারুল ইসলাম আজও কারাগারে। ২০১৪ সালে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে দেয়া মৃত্যুদণ্ডের রায়ের বিরুদ্ধে তার করা আপিলের চূড়ান্ত শুনানি এখনো শেষ হয়নি। একইসঙ্গে দলটির নিবন্ধন বাতিল নিয়ে উচ্চ আদালতে চলমান আইনি লড়াইও এখন একেবারে শেষ পর্যায়ে এসে পৌঁছেছে।
দলটির আইনজীবীদের মতে, দুটি গুরুত্বপূর্ণ মামলাই আপিল বিভাগের শুনানির অপেক্ষায় রয়েছে। চলতি সপ্তাহেই এ বিষয়ে বিচারিক প্রক্রিয়া শুরু হতে পারে বলে তারা আশা করছেন।
৩০০ আসনে প্রস্তুত জামায়াত, অপেক্ষা কেবল প্রতীক ও নিবন্ধনের
নির্বাচন কমিশন এখনো আসন্ন নির্বাচনের নির্ধারিত সময়সূচি ঘোষণা করেনি। তবে বেশিরভাগ রাজনৈতিক দলই প্রস্তুতি নিচ্ছে পুরোদমে। জামায়াতও পিছিয়ে নেই। দলটি প্রায় ৩০০ আসনে প্রার্থী চূড়ান্ত করেছে ইতোমধ্যে। কিন্তু নিবন্ধন ও নির্বাচনি প্রতীক পুনরুদ্ধার না হওয়ায় এক ধরনের আইনি অনিশ্চয়তা রয়ে গেছে। এর জেরে হতাশা দেখা দিয়েছে তৃণমূল পর্যায়ের নেতাকর্মীদের মধ্যে। তারা বলছেন, নির্বাচনের আগে এসব সমস্যার সমাধান চাই, তা না হলে গণতান্ত্রিক অধিকার আবারও প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়বে।
আইনি প্রক্রিয়ার অগ্রগতি নিয়ে আশাবাদী জামায়াত
জামায়াতের আইনজীবী শিশির মনির জানিয়েছেন, হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে তারা একটি ‘সার্টিফিকেট আপিল’ করেছেন, যেটি সংবিধান সংক্রান্ত গুরুতর প্রশ্নের অন্তর্ভুক্ত হওয়ায় পূর্ণাঙ্গ শুনানি দরকার। শুনানি শুরুর পর বিচারপতির দুর্ঘটনার কারণে তা পিছিয়ে যায়, তবে এখন আদালত খোলার পর আগামী ২২ এপ্রিল থেকে নতুন করে শুনানি শুরুর আশা করছেন তারা।
আরেক আইনজীবী ব্যারিস্টার ইমরান সিদ্দিক জানান, নিবন্ধন মামলাটি এখন শুনানির চূড়ান্ত ধাপে রয়েছে। পাশাপাশি এটিএম আজহারুল ইসলামের মামলায় আপিল বিভাগের অনুমতি পাওয়া গেছে এবং ২২ এপ্রিল এ বিষয়ে শুনানির দিন ধার্য আছে।
জামায়াতের গঠনতন্ত্র অসাংবিধানিক নয়—জোরালো যুক্তি আইনজীবীদের
জামায়াতের আইনজীবীরা দাবি করছেন, দলটির গঠনতন্ত্র মোটেও সংবিধানবিরোধী নয়। সংবিধানের ৩৮ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, সংগঠন ও রাজনৈতিক দল গঠনের অধিকার প্রতিটি নাগরিকের রয়েছে। অতীতের মতো জামায়াত সব নির্বাচনেই অংশগ্রহণ করেছে এবং জাতীয় সংসদে তাদের ৫৫ জন নেতা প্রতিনিধিত্ব করেছেন। তাদের মধ্যে ৫ জন নারীও ছিলেন।
প্রতীক সংক্রান্ত যুক্তির বিষয়ে আইনজীবীরা বলছেন, ‘দাঁড়িপাল্লা’ প্রতীক অনেক যুগ ধরে জামায়াতের সঙ্গে যুক্ত এবং এটি নির্বাচন কমিশনের বরাদ্দ। সুপ্রিমকোর্টের এখতিয়ার নয় প্রতীক বরাদ্দ দেওয়া। যদি আপিল আদালত জামায়াতের আবেদন গ্রহণ করেন, তবে নিবন্ধনসহ প্রতীক ফেরত পাওয়ারও সম্ভাবনা রয়েছে।
কীভাবে বাতিল হয়েছিল নিবন্ধন?
২০০৯ সালে সৈয়দ রেজাউল হক চাঁদপুরীর নেতৃত্বে ২৫ ব্যক্তি জামায়াতের নিবন্ধন বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে রিট করেন। ২০১৩ সালের ১ আগস্ট হাইকোর্ট তিন সদস্যের বেঞ্চে সংখ্যাগরিষ্ঠ মতের ভিত্তিতে জামায়াতের নিবন্ধন অবৈধ ঘোষণা করে রায় দেন। সেই রায়ের বিরুদ্ধে আপিল ও লিভ টু আপিল দায়ের করা হয়, যা ২০২৩ সালের ১৯ নভেম্বর খারিজ হয়। পরে সময়সীমা মওকুফ করে রিভিউ চেয়ে আবেদন করলে ২০২৩ সালের ২২ অক্টোবর আপিল বিভাগ সেটি মঞ্জুর করে রায় পুনরুজ্জীবিত করেন।
এটিএম আজহারুল ইসলামের মামলার সর্বশেষ অবস্থা
২০১৪ সালের ৩০ ডিসেম্বর আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল মুক্তিযুদ্ধকালীন মানবতাবিরোধী অপরাধে এটিএম আজহারুল ইসলামকে মৃত্যুদণ্ড দেন। ২০১৫ সালে তিনি আপিল করেন। ২০১৯ সালের ৩১ অক্টোবর আপিল বিভাগ তার মৃত্যুদণ্ড বহাল রাখেন এবং ২০২০ সালের মার্চে পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশিত হয়। এরপর তিনি রিভিউ আবেদন করেন, যা শুনানির জন্য গৃহীত হয় এবং ২২ এপ্রিল চূড়ান্ত শুনানি হওয়ার কথা রয়েছে।
সামনে কী হতে পারে?
২২ এপ্রিল থেকে শুরু হওয়া আপিল বিভাগের শুনানি জামায়াতে ইসলামীর রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ নির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক হয়ে উঠতে পারে। দলটির নিবন্ধন পুনরুদ্ধার ও প্রতীক ফিরে পাওয়ার পাশাপাশি এটিএম আজহারুল ইসলামের মুক্তির বিষয়ে উচ্চ আদালতের সিদ্ধান্ত দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতিতেও গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলবে।
জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি আবদুল হালিম বলেন, “সংবিধান ও আইনের প্রতি আমরা শ্রদ্ধাশীল। আশা করছি, আমরা ন্যায়বিচার পাব। নিবন্ধন ফিরে পেলে দেশের গণতান্ত্রিক রাজনীতি আরও সুসংহত হবে।”
বাংলাবার্তা/এমএইচ