
ছবি: সংগৃহীত
আগামী জাতীয় নির্বাচনের আগে নির্বাচন কমিশনের (ইসি) নিবন্ধন তালিকায় ঠাঁই পেতে মরিয়া হয়ে উঠেছে দেশের নানা প্রান্তে গড়ে ওঠা অসংখ্য রাজনৈতিক দল। এ বছর এ পর্যন্ত নিবন্ধনের জন্য ইসিতে আবেদন করেছে মোট ৬৫টি রাজনৈতিক দল। এর বাইরে আরও ৪৬টি দল সময় বাড়ানোর আবেদন জানিয়েছে। এই দলগুলোর বেশিরভাগই সম্পূর্ণ অপরিচিত, নামসর্বস্ব, মাঠপর্যায়ে কার্যক্রম নেই বললেই চলে—তবু নিবন্ধন পেতে মরিয়া। তাদের অনেকের নাম এতটাই ব্যতিক্রমী ও বাহারি যে রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে কৌতুক কিংবা কৌতূহলের জন্ম দিয়েছে।
বাহারি ও বিস্ময়কর নাম
ইসির কর্মকর্তাদের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, যেসব রাজনৈতিক দল নিবন্ধন চেয়ে আবেদন করেছে, তার মধ্যে রয়েছে—‘জনতার কথা বলে’, ‘বাংলাদেশ শান্তির দল’, ‘দেশ বাঁচাও মানুষ বাঁচাও আন্দোলন’, ‘জাতীয় ভূমিহীন পার্টি’, ‘বাংলাদেশ বেকার সমাজ’, ‘বাংলাদেশ জনপ্রিয় পার্টি’, ‘নতুন সূর্য আন্দোলন’, ‘আলোকবর্তিকা ফ্রন্ট’, ‘জাতীয় মা-ছেলে ঐক্য পার্টি’, ‘গণপদযাত্রা দল’, এমনকি ‘বাত্তির নিচে অন্ধকার বিরোধী দল’-এর মতো নামও রয়েছে!
নিবন্ধনের আবেদন করা দলগুলোর প্রায় সবকটিই মাঠপর্যায়ে তেমন কোনো কর্মকাণ্ড চালায় না। অধিকাংশেরই নেই কোনো কেন্দ্রীয় কার্যালয়, নেই জেলা ও উপজেলায় কার্যকর কমিটি, এমনকি দলের নীতি-আদর্শ কিংবা ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার দিকেও নেই সুস্পষ্ট দৃষ্টিভঙ্গি।
নিবন্ধনের আবেদনের সময় বাড়ানো
নতুন দলের নিবন্ধনের জন্য নির্বাচন কমিশন ১০ মার্চ গণবিজ্ঞপ্তি জারি করে। সেই বিজ্ঞপ্তি অনুযায়ী আবেদনের শেষ সময় ছিল ২০ এপ্রিল। কিন্তু নির্ধারিত সময়ের মধ্যে অনেক দল আবেদন প্রস্তুত করতে পারেনি দাবি করে সময় বৃদ্ধির আবেদন জানায়। সেই প্রেক্ষিতে নির্বাচন কমিশন তাদের আবেদন বিবেচনায় নিয়ে সময়সীমা দুই মাস বাড়িয়ে ২২ জুন পর্যন্ত করেছে।
ইসি সচিব মো. আখতার আহমেদ বলেন, ‘অনেক নবীন রাজনৈতিক দল, বিশেষত সাম্প্রতিক গণআন্দোলন থেকে উঠে আসা সংগঠনগুলো নিবন্ধনের প্রয়োজনীয় কাগজপত্র সংগ্রহ ও মাঠপর্যায়ের প্রমাণাদি প্রস্তুত করতে আরও সময় চেয়েছে। সেসব পর্যালোচনা করে কমিশন সময় বৃদ্ধির সিদ্ধান্ত নেয়।’
ইতিহাসে নজির: আগের নিবন্ধন চক্র
২০১৮ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে নিবন্ধনের জন্য ৯৩টি দল আবেদন করেছিল। তবে তৎকালীন প্রাথমিক যাচাই-বাছাইয়ে ৮১টি দলের আবেদন বাতিল হয়ে যায়, মূলত প্রয়োজনীয় নথিপত্র, সাংগঠনিক কাঠামো ও মাঠপর্যায়ের কার্যক্রমের অভাব থাকায়। ইসি পরবর্তীতে ১২টি দলের মাঠপর্যায়ের তথ্য যাচাইয়ের সিদ্ধান্ত নেয়। যাচাই-বাছাই শেষে শুধুমাত্র দুটি দল—‘গণ অধিকার পরিষদ’ ও ‘এবি পার্টি’—কে নিবন্ধন প্রদান করা হয়।
নির্বাচন কমিশনের অভিজ্ঞ কর্মকর্তারা বলছেন, এবারও অনুরূপ পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে। কারণ অধিকাংশ দলই কেবলমাত্র একটি নাম ও কাগজপত্র নিয়ে এসেছে, যাদের রাজনীতিতে দৃশ্যমান কোনো ভূমিকাই নেই। নির্বাচন কমিশন বরাবরই মাঠপর্যায়ে দলীয় কর্মকাণ্ড, সুশৃঙ্খল সংগঠন কাঠামো, নির্বাচনে অংশগ্রহণ, গণতান্ত্রিক আদর্শ ও রাজনৈতিক উদ্দেশ্য যাচাই করে নিবন্ধন দিয়ে থাকে।
‘নিবন্ধন নয়, পরিচিতি চায় অনেকে’
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন, অনেক নতুন রাজনৈতিক দল আসলে নিবন্ধনের মাধ্যমে আইনি বৈধতা বা নির্বাচনে অংশ নেওয়ার চেয়ে নিজেদের পরিচিতি বা স্বীকৃতি অর্জনের লক্ষ্যেই এই পথে হাঁটছে। কিছু ক্ষেত্রে দেখা যায়, ব্যবসায়ী, পেশাজীবী কিংবা সাবেক আমলারা দল গঠন করে নিবন্ধনের চেষ্টা করেন কেবল নামের সামনে ‘রাজনৈতিক দলের প্রধান’ বা ‘চেয়ারম্যান’ উপাধি বসানোর জন্য।
বিশেষজ্ঞদের মতে, রাজনৈতিক দল গঠনের স্বাধীনতা থাকলেও নির্বাচন কমিশনের উচিত দলগুলোর প্রকৃত কার্যক্রম, জনপ্রিয়তা ও রাজনৈতিক নীতিমালার যথাযথ মূল্যায়ন করা, যাতে রাজনৈতিক পরিবেশে শৃঙ্খলা থাকে এবং নির্বাচনে বাস্তবধর্মী দলগুলোর অংশগ্রহণ নিশ্চিত হয়।
সামনে কী?
যেহেতু নিবন্ধনের সময়সীমা এখনো বাকি, ধারণা করা হচ্ছে আরও ২০-৩০টি দল শেষ সময়ে আবেদন করতে পারে। এর ফলে মোট আবেদন সংখ্যা ৮০ ছাড়িয়ে যেতে পারে। তবে শেষ পর্যন্ত কয়টি দল নিবন্ধন পাবে, তা নির্ধারিত হবে ইসির কঠোর যাচাই-বাছাই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে। নির্বাচন যতই ঘনিয়ে আসছে, নিবন্ধনের তালিকায় ঠাঁই পেতে বাহারি দলের উপস্থিতিও ততই বাড়ছে।
সার্বিকভাবে বলা যায়, নিবন্ধন চাওয়া রাজনৈতিক দলগুলোর এই ব্যতিক্রমী নাম ও রাজনৈতিক কার্যকলাপের অভাব সাধারণ মানুষ এবং পর্যবেক্ষকদের মনে প্রশ্ন তুলছে—আসলে কি এরা সত্যিকারের রাজনৈতিক দল, না কি নামের পেছনে অন্য কোনো উদ্দেশ্য লুকিয়ে আছে? নির্বাচন কমিশনের ওপর তাই দ্বায়িত্ব বর্তেছে—দেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতিকে সুস্থ ধারায় রাখার লক্ষ্যে সঠিক ও কার্যকর দলগুলোকেই নিবন্ধনের অনুমতি দেওয়া।
বাংলাবার্তা/এমএইচ