
ছবি: সংগৃহীত
জাতীয় ঐকমত্য প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য নিয়ে গঠিত কমিশনের সঙ্গে বিএনপির চলমান সংলাপ মঙ্গলবার (২২ এপ্রিল) গড়াল তৃতীয় দিনে। এই ঐতিহাসিক আলোচনার প্রতিটি ধাপই হচ্ছে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সরাসরি দিকনির্দেশনায়। আলোচনার শুরুতে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহ-সভাপতি অধ্যাপক ড. আলী রীয়াজ একথা জানিয়েছেন।
বেলা ১১টার দিকে জাতীয় সংসদ ভবনের ল' ডিপার্টমেন্ট (এলডি) হলে বিএনপির ৫ সদস্যের প্রতিনিধি দলের সঙ্গে আলোচনা শুরুর আগে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে ড. রীয়াজ বলেন, “প্রতিদিনের আলোচনা শেষে আমরা প্রধান উপদেষ্টাকে অবহিত করছি। তার পরামর্শ ও দিকনির্দেশনা অনুযায়ী পরবর্তী আলোচনার কাঠামো নির্ধারণ করা হচ্ছে।”
তিনি বলেন, “আমরা এমন একটি সময়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছি, যা নিঃসন্দেহে বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে একটি মোড় ঘোরানো অধ্যায় হয়ে থাকবে। দেশের বিভিন্ন সংকট নিরসনে সংস্কারের যে প্রস্তাবনা উত্থাপিত হয়েছে, তা নিয়ে আমরা গভীর মনোযোগ ও দায়বদ্ধতার সঙ্গে কাজ করছি। সংশ্লিষ্ট প্রতিটি কমিশনের সঙ্গে আলোচনা করে, রাজনৈতিক দলগুলোর মতামত সংহত করে আমরা এগিয়ে যাচ্ছি একটি জাতীয় ঐকমত্যের দিকে।”
আলোচনায় অগ্রগতি ও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা
ড. আলী রীয়াজ জানান, আজকের বৈঠকে বিএনপির সঙ্গে প্রাথমিক পর্যায়ের আলোচনা সম্পন্ন হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। “আমরা আশা করছি, আজকের মধ্যেই বিএনপির প্রাথমিক প্রতিক্রিয়া এবং তাদের সুপারিশ সম্পর্কে একটি সম্যক ধারণা নিতে পারব।”
এ পর্যন্ত ৩৫টি রাজনৈতিক দল রাষ্ট্র সংস্কার ও শাসনব্যবস্থার কাঠামোতে পরিবর্তনের লক্ষ্যে প্রস্তাবনা জমা দিয়েছে। তার মধ্যে বিএনপিসহ ১৫টি দলের সঙ্গে সরাসরি আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়েছে। মে মাসে শুরু হবে দ্বিতীয় পর্যায়ের সংলাপ, যেখানে ইতোমধ্যে প্রস্তাব দেওয়া দলগুলোর সঙ্গে পরবর্তী দফায় আলোচনা করা হবে।
বিএনপির সঙ্গে ধারাবাহিক সংলাপ
এই আলোচনার প্রথম দিন ছিল ১৭ এপ্রিল এবং দ্বিতীয় দিন ২০ এপ্রিল। উভয় দিনই প্রস্তাবনার নির্দিষ্ট দিকনির্দেশনা ও বাস্তবায়নের উপায় নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়। বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদের নেতৃত্বে প্রতিনিধি দলে ছিলেন আরও চারজন জ্যেষ্ঠ নেতা। উল্লেখ্য, গত ২৩ মার্চ বিএনপি আনুষ্ঠানিকভাবে তাদের সংস্কার প্রস্তাবনা জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের কাছে জমা দেয়। সেই প্রস্তাবনায় ছিল বিচার বিভাগীয় স্বাধীনতা, নির্বাচন কমিশনের পুনর্গঠন, প্রশাসনিক কাঠামো সংস্কার, মৌলিক অধিকার নিশ্চিতকরণসহ মোট ২১টি মূল প্রস্তাবনা।
ঐকমত্য কমিশনের পটভূমি
গত বছরের ৫ আগস্ট রাজনৈতিক অচলাবস্থা ও গণআন্দোলনের মুখে ক্ষমতা ছাড়ে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকার। এরপর অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্ব নেয় অর্থনীতিবিদ ও নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে গঠিত প্রশাসন। দেশের প্রশাসনিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক কাঠামো সংস্কারে সরকার দুটি ধাপে ১১টি কমিশন গঠন করে। এর মধ্যে বিচার বিভাগ, নির্বাচন কমিশন, দুর্নীতি দমন, স্থানীয় সরকার, গণমাধ্যম, অর্থনৈতিক পুনর্গঠন ও মানবাধিকার কমিশন উল্লেখযোগ্য।
এই ১১টি কমিশনের সুপারিশ ও প্রস্তাবনাগুলোকে একত্র করে একটি জাতীয় ঐকমত্যের ভিত্তি গড়ে তুলতেই ১৫ ফেব্রুয়ারি শুরু হয় ‘জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের’ কার্যক্রম, যার নেতৃত্বে রয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা নিজে। আর সহ-সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন ড. আলী রীয়াজ।
সম্ভাবনার দিক
আলোচনার পরিবেশ ও ভাষ্য থেকে এটি স্পষ্ট যে, অন্তর্বর্তীকালীন সরকার রাজনৈতিক দলগুলোর মতামতকে গুরুত্ব দিয়ে একটি সর্বজনীন ও গ্রহণযোগ্য জাতীয় কাঠামো প্রতিষ্ঠায় কাজ করছে। ড. রীয়াজের কথায়ও উঠে এসেছে সেই সংকল্প, “আমরা চাই, এমন একটি রাষ্ট্র ব্যবস্থা তৈরি হোক যা ভবিষ্যতের প্রজন্মের জন্য ন্যায্যতা, জবাবদিহি এবং রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার একটি ভিত্তি হয়ে থাকবে।”
জাতীয় ঐকমত্য গঠনের এই উদ্যোগ দেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে একটি ব্যতিক্রমী অধ্যায় হয়ে উঠতে পারে যদি তা সকল অংশীজনের সম্মতিতে চূড়ান্ত রূপ পায়। এখন দেশের মানুষ তাকিয়ে আছে—বিএনপিসহ অন্যান্য রাজনৈতিক দলের সঙ্গে এই আলোচনার ফলাফল কী হয়, এবং কত দ্রুত তা বাস্তবায়নের পথে এগোয়।
বাংলাবার্তা/এমএইচ