
ছবি: সংগৃহীত
এক দশকেরও বেশি সময় ধরে ক্ষমতায় থাকা বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ এখন এক গভীর অস্তিত্ব সংকটে। ছাত্র-জনতার প্রতিরোধ, দমন-পীড়নের বিরুদ্ধে গণআন্দোলনের মুখে ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট ক্ষমতাচ্যুত হওয়া দলটি বর্তমানে রাজনৈতিকভাবে অচলাবস্থার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে। ক্ষমতা হারানোর পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দেশত্যাগ, দলের শীর্ষ নেতৃত্বের ভারত ও পশ্চিমা দেশে আত্মগোপন, আর দেশের ভেতরে নেতাকর্মীদের ব্যাপক ধরপাকড়ের ফলে এই সংকট আরও প্রকট হয়ে উঠেছে। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, বাংলাদেশে স্বাধীনতা যুদ্ধের নেতৃত্বদানকারী ৭৬ বছর বয়সী এই প্রাচীনতম রাজনৈতিক দল আজ কার্যত অস্তিত্ব রক্ষার লড়াইয়ে নেমেছে।
স্বঘোষিত নির্বাসন, ছিন্নমূল সংগঠন
আওয়ামী লীগের বেশিরভাগ কেন্দ্রীয় নেতা এখন ভারতে, যুক্তরাষ্ট্রে বা ইউরোপের বিভিন্ন দেশে আশ্রয় নিয়ে রয়েছেন। শেখ হাসিনার নেতৃত্বে দলটি দীর্ঘ ১৫ বছর ধরে যেভাবে একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তার করে দেশ চালিয়েছে, তার পতনের পর যে শূন্যতা তৈরি হয়েছে, তা পূরণে দলটি ভেতরে-বাইরে গভীরভাবে হিমশিম খাচ্ছে।
বিবিসি বাংলার অনুসন্ধানী প্রতিবেদন অনুযায়ী, এখন দলটির অভ্যন্তরে একটি প্রবল চাপ তৈরি হয়েছে—দেশের মাটিতে প্রকাশ্যে এসে সংগঠনের হাল ধরতে পারে এমন কাউকে সামনে নিয়ে আসা নিয়ে। দেশের বাইরে অবস্থানরত নেতাদের মতে, “ছায়ানেতৃত্ব” দিয়ে সংগঠন পরিচালনা করে এখন আর সম্ভব নয়। কারণ, মাটি থেকে বিচ্ছিন্ন দল বেশিদিন টিকে থাকতে পারে না।
এই প্রেক্ষাপটে কিছু সম্ভাব্য নেতৃত্বের নাম ঘুরে ফিরে আসছে। তাদের মধ্যে আছেন সাবেক রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ এবং সাবেক মন্ত্রী ও জাতিসংঘে বাংলাদেশের সাবেক স্থায়ী প্রতিনিধি সাবের হোসেন চৌধুরী। তারা রাজনৈতিকভাবে তুলনামূলকভাবে কম বিতর্কিত হলেও, বর্তমান বাস্তবতায় কেউই সামনে এগিয়ে আসার সাহস দেখাচ্ছেন না। একদিকে মামলার ভয়, অন্যদিকে রাজনৈতিক প্রতিশোধের শঙ্কায় তারা নীরব আছেন।
আনুষ্ঠানিক ঘোষণা না দিলেও, চেষ্টার ঘাটতি নেই
বিদেশে অবস্থানরত আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতাদের মতে, দলের কেন্দ্র থেকে এখনই কারো নাম মুখপাত্র বা নতুন নেতা হিসেবে ঘোষণা করা হলে তিনি তাৎক্ষণিকভাবে মামলার মুখে পড়তে পারেন। ফলে দলটি চায়, কেউ স্বতঃস্ফূর্তভাবে সামনে এসে নেতৃত্বে এগিয়ে আসুক—তাকে তখনো ‘লিডারশিপ’ দেওয়া হবে।
শেখ হাসিনা নিজেও সাম্প্রতিক ভার্চুয়াল বৈঠকে বলেছেন, “দেশে যারা সাহস করে সামনে আসবেন, তারাই নেতৃত্বের যোগ্য।” কিন্তু এখনও তেমন কাউকে দেখা যাচ্ছে না। বিভিন্ন মহল থেকে বলা হচ্ছে, দীর্ঘদিন ধরে দমননীতি চালানোর কারণে দলে নতুন নেতৃত্ব তৈরি হয়নি। যারা ছিলেন, তারা এখন নির্বাসনে অথবা আত্মগোপনে।
‘রিফাইন্ড আওয়ামী লীগ’ নয়, বরং পুরোনো অবস্থানেই অনড়
অনেকে ধারণা করেছিলেন, দীর্ঘ শাসনের ভুলত্রুটি স্বীকার করে নতুন এক ‘রিফাইন্ড আওয়ামী লীগ’ গঠনের চেষ্টা হতে পারে। কিন্তু বাস্তবে দলটির নেতাকর্মীদের মধ্যে তেমন কোনো আত্মসমালোচনা বা অনুশোচনার নমুনা দেখা যাচ্ছে না। বরং অনেকে এখনো বিশ্বাস করে, তাদের সরকার ষড়যন্ত্রের শিকার হয়ে ক্ষমতাচ্যুত হয়েছে।
বিদেশে অবস্থানরত সাবেক তথ্য প্রতিমন্ত্রী মোহাম্মদ আলী আরাফাত বলেন, “আমরা সব হত্যাকাণ্ডের বিচার চাই। কিন্তু আওয়ামী লীগ রাজনৈতিক দল হিসেবে জনগণের কাছে দায়বদ্ধ। অন্য কোনো পক্ষের প্রশ্নের জবাব দেওয়া আমাদের প্রয়োজন নেই।”
একইসঙ্গে ইউরোপ ও আমেরিকায় অবস্থানরত আওয়ামী লীগের অন্যান্য নেতারাও স্বীকার করেছেন, পরিস্থিতি মোকাবেলায় তাদের কিছু ভুল ছিল, তবে তা দলগতভাবে এখনো স্বীকার করা হয়নি। নেতারা বলছেন, ভবিষ্যতে পরিকল্পনা অনুযায়ী আনুষ্ঠানিক বক্তব্য দেওয়া হবে, সে বিষয়ে তারা প্রস্তুতি নিচ্ছেন।
ভেঙে পড়া কাঠামো, ঘুরে দাঁড়ানোর প্রশ্ন
ঢাকা থেকে শুরু করে উপজেলা পর্যায় পর্যন্ত আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতাকর্মীদের অনেকে এখন কারাবন্দি বা পলাতক। অনেক জায়গায় পার্টি অফিস বন্ধ, কর্মসূচি নেই, মাঠে নেই কোনো সাড়া। যারা মাঠে ছিলেন, তারাও এখন রাজনৈতিকভাবে নিঃস্ব।
তবে রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, আওয়ামী লীগের মতো একটি বৃহৎ সংগঠনের পেছনে এখনো অর্থনৈতিক ও প্রবাসী সমর্থনের একটি বলয় আছে। প্রশ্ন হলো—এই বলয় কতটা কার্যকরভাবে ব্যবহার করে দলটি মাঠে ফিরতে পারবে? আদৌ কি তারা এমন একজন নেতাকে খুঁজে পাবে, যিনি বর্তমান বাস্তবতায় দলটিকে আদর্শিক ও সাংগঠনিক দিক থেকে পুনর্গঠিত করতে পারবেন?
ভবিষ্যত অনিশ্চিত, তবে চেষ্টা চলছে
বর্তমানে আওয়ামী লীগ এমন এক সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে, যেখানে পুরোনো কৌশল কাজ করছে না, আবার নতুন কৌশল এখনো গড়ে ওঠেনি। সময়মতো যদি দলটি নিজেদের নেতৃত্ব সংকট কাটিয়ে দেশের ভেতর থেকে একজন গ্রহণযোগ্য মুখ খুঁজে না পায়, তবে এ দলের রাজনৈতিক ভবিষ্যত দীর্ঘ সময়ের জন্য ঝুঁকিতে পড়তে পারে।
এই মুহূর্তে আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে সবচেয়ে বড় প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে—কে হবেন শেখ হাসিনার অনুপস্থিতিতে দলটির পরবর্তী পথনির্দেশক? তিনি কি হবেন কৌশলী কোনো ‘নেতা’ নাকি হঠাৎ করে উদিত কোনো নতুন মুখ?
এ প্রশ্নের উত্তর হয়তো সময়ই দেবে। তবে যতদিন সেই উত্তর না মেলে, ততদিন আওয়ামী লীগ থাকবে পুনর্গঠনের সন্ধানে, নেতৃত্বের সংকটে।
সূত্র: বিবিসি বাংলা, রয়টার্স, ভয়েস অফ আমেরিকা
বাংলাবার্তা/এমএইচ