
ছবি: সংগৃহীত
গত আট মাসে বাংলাদেশের রাজনীতিতে এক অদ্ভুত প্রবণতার জন্ম হয়েছে। শেখ হাসিনার সরকারের পতনের পর অন্তর্বর্তী সরকারের অধীনে চলমান এই সময়ে কমপক্ষে ২৬টি নতুন রাজনৈতিক দল ও প্ল্যাটফর্ম আত্মপ্রকাশ করেছে। কারও কারও চোখে এটি গণতান্ত্রিক বহুত্ববাদ ও রাজনৈতিক অংশগ্রহণের বিকাশ, আবার অনেকে বলছেন এটি রাজনৈতিক বাজারে বিভ্রান্তি ও ব্যক্তিস্বার্থ রক্ষার খেলার নতুন কৌশল।
এই সময়ের মধ্যে আত্মপ্রকাশকারী দলের মধ্যে রয়েছে নিউক্লিয়াস পার্টি, জনপ্রিয় পার্টি, জাগ্রত পার্টি, আমজনতার দল, আ-আম জনতা পার্টি, সার্বভৌমত্ব আন্দোলন, মুক্তির ডাক ৭১, জাতীয় বিপ্লবী পরিষদসহ আরও অনেক নাম। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, নির্বাচনের গন্ধ পেলে অতীতে যেমন এরশাদের আমলে ব্যাঙের ছাতার মতো দল গজিয়ে উঠেছিল, বর্তমান পরিস্থিতিও তার ব্যতিক্রম নয়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক সাব্বির আহমেদ বলেন, “এখন একটা বদ্ধমূল ধারণা হয়ে গেছে সবার মধ্যে যে রাজনীতি করলে খুব দ্রুত লাভবান হওয়া যায়। তাই অনেকেই রাজনীতিকে একটা বিনিয়োগ হিসেবে দেখছে। আদর্শ, দর্শন এসব মুখোশ মাত্র।”
তিনি আরও বলেন, “আদর্শ বা গণতান্ত্রিক চর্চার জায়গা খুব কম, বরং দেখা যাচ্ছে কে কত দ্রুত রাজনৈতিক পরিচয় অর্জন করে প্রশাসনের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পারে, সেটাই মুখ্য হয়ে দাঁড়াচ্ছে।”
ডেসটিনি গ্রুপের আলোচিত পরিচালক মোহাম্মদ রফিকুল আমীনের দল গঠন তারই প্রমাণ। ১২ বছরের কারাদণ্ড ভোগের পর তিনি দাবি করছেন, রাজনৈতিক লেবেল না থাকার কারণে তিনি জেল থেকে ছাড় পাননি। তার ভাষায়, “যেদিন হাসিনা পালায়, পরদিন থেকে সবাইকে ছাড়া হচ্ছে। আমি সুপার সাহেবকে বললাম আমাকে কেন ছাড়েন না? উনি বললেন, আপনি তো কোনো রাজনৈতিক দল করেন না। আপনি যদি অন্তত হরকাতুল জিহাদও করতেন, আপনাকে ছাড়তাম।”
তিনি বলেন, “এই দল শুধু রাজনৈতিক অভিলাষ নয়, বরং প্রশাসনের কাছে আমার জুলুমের কথা জানানোর একটা প্ল্যাটফর্ম।”
রাজনৈতিক বিশ্লেষক মহিউদ্দিন আহমদ বলেন, “এটি অনেকটাই শাসকের সঙ্গে বোঝাপড়ার মাধ্যম। এরশাদের আমলেও এমন হয়েছিল, যখন বড় দলগুলো নির্বাচন বয়কট করেছিল। তখন সরকার দেখাতে চেয়েছিল দেশে বহু দল আছে যারা নির্বাচনে আগ্রহী।”
তিনি বলেন, “আমরা তখন দেখেছিলাম ১২০টির বেশি দলের আত্মপ্রকাশ হয়েছিল, যার অনেকগুলো কাগজ-কলমেই সীমাবদ্ধ ছিল।”
ঢাকার রাজপথে কথা হয় এক ভ্যানচালক মো. হারুনের সঙ্গে। তিনি বলেন, “বাংলাদেশে মনে করেন ১০ জনেও দল করা যায়। যার যার মতো খালি দল বানাইতাছে। এগুলা দল আমরা ভ্যান গাড়িয়ালারাও বানাইতে পারি।”
চা বিক্রেতা জোছনা বলেন, “প্রায়ই দেখি মিছিল হয়, কিন্তু কারা করে জানি না। নতুন দলের নামও শুনি না।”
বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া শিক্ষার্থী আসমা উল হুসনা সুপ্তি বলেন, “স্টুডেন্টদের সংগঠন বাদে তেমন কিছু চোখে পড়ে না। যেসব নতুন দল এসেছে তাদের আদর্শ কী, উদ্দেশ্য কী – এসব স্পষ্ট না।”
চাকরিজীবী সালমা আক্তার বলেন, “আমি তো ভেবেছি ‘আমজনতা’ মানে সবার কথা বোঝায়, এটা যে দল তার কোনো খবরই ছিল না।”
বিশ্লেষকরা বলছেন, এই দল গঠনের প্রবণতা একদিকে ভোটের রাজনীতি ও জোট গঠনের সহজতা তৈরি করে, অন্যদিকে প্রশাসনিক সুবিধা পাওয়ারও পথ খুলে দেয়। রাজনৈতিক দল হিসেবে স্বীকৃতি পেলে অনেক ক্ষেত্রে মামলা-মোকদ্দমা, প্রশাসনিক নজরদারি এমনকি উন্নয়ন বরাদ্দের ক্ষেত্রেও সুবিধা মেলে।
সাব্বির আহমেদ বলেন, “এগুলো শুধুই ব্যক্তি বা ক্ষুদ্র গোষ্ঠীর স্বার্থে গঠিত প্ল্যাটফর্ম। গণতন্ত্রে বহুদলীয়তা থাকতে পারে, কিন্তু এর অর্থ এই নয় যে গণতন্ত্রকে একধরনের ‘বাজারি পণ্য’ বানিয়ে ফেলা হবে।”
গত আট মাসে গড়ে মাসে তিনটি করে নতুন দলের আত্মপ্রকাশ ঘটেছে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, এদের মধ্যে কে বা কারা রাজনৈতিক প্রাসঙ্গিকতা অর্জন করবে?
এনসিপি নামের ছাত্রদের দলটি কিছুটা আলোচনায় এলেও এখনো নিবন্ধন পায়নি। তাদের ব্যাকগ্রাউন্ডে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের বাস্তবতা আছে, কিন্তু অন্যদের ক্ষেত্রে এমন প্রেক্ষাপটও অনুপস্থিত।
রাজনৈতিক ইতিহাস বলছে, শতাধিক নতুন দল এলেও শেষপর্যন্ত হাতে গোনা কয়েকটি দলই টিকে থাকে এবং প্রাসঙ্গিকতা অর্জন করে।
পরিশেষে বলা যায়, নতুন নতুন দলের আত্মপ্রকাশের এই জোয়ার গণতান্ত্রিক চর্চার স্বাভাবিক রূপ নাকি রাজনৈতিক অর্থনীতির নতুন কৌশল—তা সময়ই বলে দেবে। তবে বিশ্লেষক ও সাধারণ নাগরিকদের চোখে এটি স্পষ্ট যে, এই প্রবণতার পেছনে রাজনৈতিক দর্শনের চেয়ে বেশি সক্রিয় ব্যক্তিস্বার্থ ও ক্ষমতালিপ্সা।
বাংলাবার্তা/এমএইচ