
ছবি: সংগৃহীত
দেশের ইসলামী রাজনৈতিক দলগুলো আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে ঘিরে ঐক্যবদ্ধ জোট গঠনের লক্ষ্যে ব্যস্ত সময় পার করছে। বিশেষ করে সংখ্যানুপাতিক (Proportional Representation - PR) পদ্ধতিতে নির্বাচন, নির্বাচনপূর্ব প্রয়োজনীয় রাজনৈতিক সংস্কার এবং অতীতের গণহত্যার ন্যায়বিচারের দাবিতে তারা ঐক্যমতে পৌঁছানোর চেষ্টা করছে। দীর্ঘদিনের মতপার্থক্য ও প্রতিদ্বন্দ্বিতার ইতিহাস সত্ত্বেও, বর্তমান রাজনৈতিক বাস্তবতা তাদের এক মঞ্চে আনতে প্রভাব বিস্তার করছে বলে মত বিশ্লেষকদের।
ইসলামী দলগুলোর নেতারা মনে করছেন, সাম্প্রতিক ফ্যাসিবাদী প্রবণতা ও গণতন্ত্র সংকটের প্রেক্ষাপটে তাদের মধ্যে ঐক্যের প্রয়োজন আরও তীব্র হয়ে উঠেছে। তারা বলছেন, জাতীয় স্বার্থের প্রশ্নে নিজেদের ক্ষুদ্র স্বার্থ বিসর্জন দিতে হবে। সেই লক্ষ্যে, প্রতি আসনে সম্মিলিতভাবে একক প্রার্থী নির্ধারণের পরিকল্পনাও আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে।
বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের আমীর মাওলানা মামুনুল হক এক সাক্ষাৎকারে বলেন, "নির্বাচন অবাধ, নিরপেক্ষ ও সকলের কাছে গ্রহণযোগ্য করতে হলে সংখ্যানুপাতিক ব্যবস্থায় নির্বাচন করতে হবে। তার আগে অবশ্যই প্রশাসনিক, রাজনৈতিক ও সাংবিধানিক সংস্কার প্রয়োজন। একদলীয় স্বৈরশাসন ঠেকাতে ইসলামী দলগুলোর এখন ঐক্যবদ্ধ হওয়া সময়ের দাবি।"
অন্যদিকে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের আমির চরমোনাই পীর সৈয়দ রেজাউল করিম জানান, তারা শুরু থেকেই নির্বাচন পিআর পদ্ধতিতে করার পক্ষে জোরালো দাবি জানিয়ে আসছেন। তিনি বলেন, "বর্তমান কেন্দ্রিক ভোটের ব্যবস্থায় জনগণের প্রকৃত রায় প্রতিফলিত হয় না। তাই আমরা চাই, জনগণের ভোটের প্রকৃত প্রতিফলন নিশ্চিত করতে সংখ্যানুপাতিক ব্যবস্থা চালু করা হোক।" একইসঙ্গে তিনি জামায়াতে ইসলামীর ইউরোপ সফর-পরবর্তী অবস্থান নিয়ে কিছুটা শঙ্কা প্রকাশ করেন এবং সঠিক অবস্থান স্পষ্ট করার আহ্বান জানান।
জামায়াতে ইসলামীর পক্ষ থেকে তাদের সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ার বলেন, "ইসলামী আন্দোলনের আমিরের শঙ্কাকে আমরা সম্মান করি, তবে গণমাধ্যম কিছু বিষয় অতিরঞ্জিত করে পরিবেশন করছে। বাস্তবে, ইসলামী শক্তির ঐক্য অটুট এবং আমরা সকল মতপার্থক্য পেছনে ফেলে সম্মিলিতভাবে নির্বাচনে অংশ নেয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছি। ইসলামী আন্দোলনসহ সকল ইসলামী শক্তির সঙ্গে যুগপৎ আন্দোলন ও নির্বাচনী জোট গঠন প্রক্রিয়া এগিয়ে চলেছে।"
এদিকে পর্যবেক্ষক মহল মনে করছে, ইসলামী দলগুলোর এ ধরনের উদ্যোগ রাজনৈতিক অঙ্গনে একটি নতুন মেরুকরণ সৃষ্টি করতে পারে। দীর্ঘদিন ধরে জাতীয় রাজনীতিতে দুই মূলধারার বাইরে বিকল্প শক্তির অনুপস্থিতি ছিল স্পষ্ট। ইসলামী দলগুলোর ঐক্যপ্রচেষ্টা সে শূন্যতা পূরণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষক ড. আসিফ শওকত কলিম বলেন, "ইসলামী দলগুলোর মধ্যে ঐক্য গড়ে উঠলে তা সাধারণ ধর্মপ্রাণ ভোটারদের মনোভাবেও বড়সড় প্রভাব ফেলতে পারে। বিশেষ করে যারা মূলধারার দুই বড় দলে হতাশ, তাদের মধ্যে এই নতুন জোট একটি আকর্ষণ তৈরি করতে পারে। তবে আদর্শিক বৈচিত্র্যের কারণে এই ঐক্য কতটা টেকসই হবে, সেটাই এখন দেখার বিষয়।"
আরেক বিশ্লেষক ড. শামীম রেজা মনে করেন, "সংখ্যানুপাতিক পদ্ধতির দাবি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বর্তমান ব্যবস্থায় বড় দলগুলো সব সুবিধা নিয়ে নিচ্ছে, কিন্তু সংখ্যানুপাতিক পদ্ধতি চালু হলে ছোট দলগুলোর ন্যায্য প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত হবে। ইসলামী দলগুলোর এই দাবি কেবল তাদের স্বার্থ নয়, বৃহত্তর গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার জন্যও প্রাসঙ্গিক।"
শীর্ষ নেতারা ইঙ্গিত দিয়েছেন, চলতি বছরের জুন বা জুলাইয়ের মধ্যে ইসলামী দলগুলোর সমন্বিত নির্বাচনী সমঝোতার আনুষ্ঠানিক ঘোষণা আসতে পারে। ইতিমধ্যে অভ্যন্তরীণ পর্যায়ে বৈঠক ও সংলাপের মাধ্যমে সম্মিলিত নীতিমালা ও প্রার্থী নির্ধারণের রূপরেখা তৈরি হচ্ছে।
রাজনৈতিক মহলে অনেকেই মনে করছেন, যদি এই ঐক্য সফলভাবে বাস্তবায়ন হয়, তাহলে আসন্ন নির্বাচনে এক নতুন মাত্রা যুক্ত হবে। তবে একইসঙ্গে চ্যালেঞ্জও রয়েছে—দীর্ঘদিনের পারস্পরিক অবিশ্বাস ও মতপার্থক্য দূর করা এবং জনগণের আস্থা অর্জন করা।
বাংলাবার্তা/এমএইচ