
ছবি: সংগৃহীত
শেখ মুজিবুর রহমানের সাড়ে তিন বছরের শাসনামলে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ)-এর প্রায় ৩০ হাজার নেতাকর্মী নিহত হয়েছিলেন বলে দাবি করেছেন বিএনপি চেয়ারপারসনের সাবেক প্রেসসচিব ও বিশিষ্ট রাজনীতিবিদ মারুফ কামাল খান। শনিবার দিবাগত রাত ১টার দিকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে একটি স্ট্যাটাসে তিনি এ মন্তব্য করেন, যা ইতিমধ্যেই সামাজিক মাধ্যমে ব্যাপক আলোচনার জন্ম দিয়েছে।
স্ট্যাটাসে মারুফ কামাল খান লেখেন, "বাংলাদেশের ইতিহাসে জাসদের মতো এত ব্যাপক ত্যাগ আর কোনো রাজনৈতিক দলকে করতে হয়নি। সাড়ে তিন বছরের শাসনামলে শেখ মুজিব সরকারের হাতে প্রায় ৩০ হাজার জাসদ নেতাকর্মী নিহত হয়েছিলেন।"
তিনি আরও লেখেন, "কিন্তু কোথায় আজকের জাসদ? এক সময়ের বিপুল সম্ভাবনাময় এই সংগঠন ভুল রাজনীতির কারণে নিজেই ক্ষয়ে যেতে যেতে প্রায় নিঃশেষ হয়ে গেছে।"
ফেসবুকে তীব্র প্রতিক্রিয়া
মারুফ কামালের স্ট্যাটাসটি প্রকাশের পরপরই তা নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আলোচনা শুরু হয়। অনেকেই মন্তব্যের ঘরে নিজেদের প্রতিক্রিয়া জানান।
একজন ফেসবুক ব্যবহারকারী মাইনুদ্দিন মাহাদি মন্তব্য করেন, "ইতিহাস থেকে কেউ শিক্ষা নেয় না, এটাই ইতিহাসের নির্মম শিক্ষা।"
আরেকজন ব্যবহারকারী ওয়াহেদ আলম বলেন, "জাসদের লোকেরা সেই ইতিহাস ভুলে গেছে। আজকের দিনে আওয়ামী লীগের সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ মিত্র হিসেবে তারাই কাজ করছে।"
গাজী আলাউদ্দিন আহমেদ নামের একজন মন্তব্য করেন, "জনগণের পালস বুঝতে ব্যর্থ হলে সংগঠনকে চরম খেসারত দিতে হয়। জাসদের ক্ষেত্রেও তাই হয়েছে।"
তবে, ভিন্নমতও এসেছে মন্তব্যের ঘরে। হাবিব বাবুল নামের একজন মন্তব্য করে বলেন, "৩০ হাজার সংখ্যাটা বোধহয় সঠিক না। তবে সারাদেশে যে ব্যাপক হত্যাকাণ্ড ঘটেছিল, তা অস্বীকার করার উপায় নেই। এসবের কোনো নির্ভরযোগ্য পরিসংখ্যান নেই।"
ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট
১৯৭২ সালের ৩১ অক্টোবর গঠিত হয়েছিল জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ)। আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধে অসন্তোষ, সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র গঠনের আকাঙ্ক্ষা এবং 'দুর্নীতিবাজ আমলাতন্ত্র' ও 'সামন্তবাদী শক্তির' বিরুদ্ধে সংগ্রামের ডাক দিয়ে গড়ে উঠেছিল এই দল। বিশেষ করে বঙ্গবন্ধু সরকারের শাসনামলে 'রক্ষী বাহিনী' দ্বারা ব্যাপক দমনপীড়ন ও রাজনৈতিক নিপীড়নের অভিযোগ তোলে জাসদ।
১৯৭৪-৭৫ সালের রাজনৈতিক অস্থিরতার সময়, জাসদ ও আওয়ামী লীগ সরকারের মধ্যে সম্পর্ক চরম বৈরিতায় পৌঁছায়। অভিযোগ আছে, জাসদের 'গণবাহিনী' ও আওয়ামী লীগের 'রক্ষী বাহিনী'র মধ্যে সশস্ত্র সংঘর্ষের ঘটনাও ঘটে। জাসদের আন্দোলন দমন করতে গিয়ে নানা সময়ে ব্যাপক ধরপাকড়, বিচারবহির্ভূত হত্যা ও নির্যাতনের অভিযোগ উঠেছিল। অনেক ইতিহাসবিদ ও গবেষক এসব ঘটনাকে বাংলাদেশে রাজনৈতিক সহিংসতার এক কালো অধ্যায় হিসেবে বিবেচনা করেন।
তবে '৩০ হাজার' নিহতের দাবিটি নিয়ে গবেষক ও ইতিহাসবিদদের মধ্যে ভিন্নমত রয়েছে। অনেকেই মনে করেন, সংখ্যাটি অতিরঞ্জিত হতে পারে, তবে জাসদের নেতাকর্মীদের ব্যাপক দমনপীড়নের কথা অস্বীকার করার সুযোগ নেই।
জাসদের বর্তমান অবস্থান
এক সময়ের তুমুল জনপ্রিয় ও বিপ্লবী জাসদ আজ বাংলাদেশের রাজনীতিতে গুরুত্ব হারিয়েছে। বর্তমানে জাসদের কয়েকটি ভাগ রয়েছে, যাদের কেউ কেউ সরাসরি ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের জোটসঙ্গী হিসেবে কাজ করছে। অনেকে মনে করেন, আদর্শিক অবস্থান হারিয়ে মূলস্রোতের রাজনীতিতে সুবিধাবাদী ভূমিকাই এখন জাসদের মূল চিত্র।
এ প্রসঙ্গে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলেন, এক সময়কার ত্যাগী নেতৃত্বের দল আজ বিভক্ত হয়ে পড়ে গেছে। এতে জাসদের ঐতিহাসিক ভূমিকা ও সংগ্রাম অনেকাংশেই বিস্মৃতির অতলে চলে যাচ্ছে।
মারুফ কামালের স্ট্যাটাসের গুরুত্ব
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন, এমন একটি সময় যখন বাংলাদেশের রাজনীতিতে নতুন মেরুকরণের আভাস দেখা যাচ্ছে, তখন ইতিহাসের এসব অম্ল মধুর অধ্যায় স্মরণ করিয়ে দেয়ার মাধ্যমে মারুফ কামাল খান মূলত বর্তমান প্রজন্মকে অতীতের শিক্ষা নিতে আহ্বান করেছেন।
বিশেষ করে সরকার-সমর্থিত দল ও গোষ্ঠীগুলোর সঙ্গে অতীতে বিরোধী রাজনীতির শক্তিগুলোর সংঘর্ষ ও তাদের ভাঙন কীভাবে ঘটেছে, তার একটি দৃষ্টান্ত হিসেবে জাসদের কথা টেনে এনেছেন তিনি।
মারুফ কামাল খানের এই স্ট্যাটাস বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে এক বিতর্কিত অধ্যায়কে সামনে নিয়ে এসেছে। জাসদের বিপুল ত্যাগ ও তার বর্তমান অবস্থা নিয়ে যে আলোচনার সূত্রপাত হয়েছে, তা হয়তো নতুন প্রজন্মকে অতীতের ভুল থেকে শিক্ষা নিয়ে ভবিষ্যতের জন্য সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে সহায়তা করবে।
বাংলাবার্তা/এমএইচ