ছবি সংগৃহীত
ওমরাহ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত। সারা বছরই বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে অসংখ্য মুসলিম ওমরাহ পালন করতে মক্কা ভ্রমণ করেন। বাংলাদেশ থেকেও ওমরাহযাত্রীদের সংখ্যা মোটেও কম নয়। এ ছাড়া হজ পালনার্থে সৌদি গমনকারীরা প্রথমে ওমরাহ পালন করবেন।
ওমরাহর ফজিলত
ওমরাহ পালনের অসংখ্য ফজিলতের কথা হাদিসে বর্ণিত হয়েছে। নবী কারিম (সা.) ইরশাদ করেন, ‘এক ওমরাহর পর আরেক ওমরাহ, উভয়ের মধ্যবর্তী সময়ের গোনাহের কাফফারা। আর জান্নাতই হজে মাবরুরের একমাত্র প্রতিদান।’ সহিহ মুসলিম : ১৩৪৯
ওমরাহ ওয়াজিব না সুন্নত?
ওমরাহ ওয়াজিব না সুন্নত তা নিয়ে ফিকহের ইমামদের মধ্যে মতভেদ রয়েছে। ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল ও ইমাম শাফেয়ি (রহ.)-এর মতে, ওমরাহ ওয়াজিব। পক্ষান্তরে ইমাম মালিক ও আবু হানিফা (রহ.) বলেছেন, ওমরাহ পালন করা সুন্নত। কারণ হজরত জাবের ইবনে আবদুল্লাহ (রা.) বর্ণনা করেন, নবী কারিম (সা.)-কে জিজ্ঞেস করা হলো, ‘ওমরাহ কি ওয়াজিব?’ তিনি বলেছেন, ‘না, ওমরাহ করা তোমার জন্য উত্তম।’ সুনানে দারাকুতনি : ২৭২৪
ওমরাহ কাদের জন্য
হজের মতো ওমরাহর জন্যও সুস্থ, শারীরিকভাবে সক্ষম এবং প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার পাশাপাশি আর্থিক সামর্থ্যও থাকতে হবে, তাহলেই ওমরাহ করা সুন্নত। আর্থিকভাবে সামর্থ্যবান হওয়ার মর্ম হলো, সফরের সময়ে নিজের, পরিবারের ও অধীন ব্যক্তিদের সব ধরনের খরচ নিশ্চিত করার পর ওমরাহ পালনের মতো অর্থ জমা থাকা।
হজ যেমন জীবনে একবার আদায় করা ফরজ, তেমনি ওমরাহও জীবনে অন্তত একবার আদায় করা সুন্নত। সামর্থ্যবান ব্যক্তির জন্য একাধিক ওমরাহ করতে অসুবিধা নেই। তবে হজ ফরজ থাকা অবস্থায় হজ বাদ দিয়ে বারবার ওমরাহ করা অনুচিত। অবশ্য ওমরাহ আদায় করলে হজ ফরজ হয়ে যায়, এ কথা সঠিক নয়। কারণ হজ ও ওমরাহর খরচে অনেক পার্থক্য বিদ্যমান। আর ওমরাহ হজের সফরে যেমন করা যায়, আলাদাভাবেও করা যায়। নারীদের জন্য মাহরাম পুরুষ সঙ্গে থাকার শর্ত রয়েছে।
ওমরাহ কবুল হওয়ার শর্ত
ওমরাহ একটি ইবাদত। তাই অন্যান্য ইবাদতের মতো এটিও ইখলাস ও নবী কারিম (সা.)-এর অনুসরণ ছাড়া আল্লাহর দরবারে কবুল হয় না। ওমরাহতে ইখলাসের মর্ম হলো, শুধু আল্লাহর সন্তুষ্টি ও পরকালীন সাফল্যের উদ্দেশ্যে ওমরাহ সম্পাদন করা; কোনো ধরনের পার্থিব উদ্দেশ্য এখানে গ্রহণযোগ্য নয়; বিশেষ করে প্রচারপ্রিয়তা ইবাদতের সওয়াব নষ্ট করে দেয়। আর নবী কারিম (সা.)-এর অনুসরণের মর্ম হলো, তিনি যেভাবে ওমরাহ পালন করেছেন, সাহাবিদের শিখিয়েছেন এবং সম্মতি দিয়েছেন, সেভাবেই তা পালন করা।
ওমরাহর প্রধান চার কাজ
ওমরাহ পালনে প্রধানত চারটি কাজ। যথা-
-ইহরাম পরিধান করা।
-পবিত্র কাবাঘর তাওয়াফ করা।
-সাফা ও মারওয়ার মধ্যবর্তী (সবুজ বাতি) স্থানে সাতবার সায়ি করা।
-মাথার চুল মুণ্ডন করা বা ছোট করা।
ইহরাম পরিধানের নিয়ম
ইহরাম পরিধানের আগে সব ধরনের শারীরিক পরিচ্ছন্নতা অর্জন করতে হবে। যেমন হাত-পায়ের নখ কাটা, গোঁফ, চুল ও নাভির নিচের লোম পরিষ্কার করা ইত্যাদি। ইহরাম পরিধানের আগে ফরজ গোসলের মতো করে গোসল করা সুন্নত। তারপর মাথা বা দাড়িতে সুগন্ধি লাগানো। এরপর ফরজ নামাজের ওয়াক্ত হলে ফরজ নামাজ আদায় করবেন, অন্যথায় অজুর সুন্নত হিসেবে দুই রাকাত নামাজ আদায় করবেন। নামাজের পর কিবলামুখী হয়ে ইহরাম পরিধান করবেন। পুরুষদের সেলাইবিহীন পোশাক ও নারীদের যেকোনো উপযুক্ত পোশাক পরিধানের মাধ্যমে ইহরাম পরিধান করতে হবে। ইহরামের জন্য নির্দিষ্ট স্থান মিকাতে বা মিকাতে আসার আগে ওমরাহর নিয়ত করতে হবে এবং ইহরাম পরতে হবে। এরপর তালবিয়া পড়তে হবে।
ইহরামের দোয়া ও তালবিয়া
ইহরামের সময় ওমরাহর নিয়ত করে এ দোয়া পড়া যায়
উচ্চারণ: আল্লাহুম্মা ইন্নি উরিদুল উমরাতা ফা-ইয়াসসিরহা লি ওয়া তাকাব্বালহা মিন্নি।
অর্থ: হে আল্লাহ! আমি ওমরাহর ইচ্ছা করছি; আপনি আমার জন্য তা সহজ করে দিন এবং আমার পক্ষ থেকে তা কবুল করুন।
এরপর বলবেন, ‘লাব্বাইক আল্লাহুম্মা বি-ওমরতিন (অর্থ হে আল্লাহ, ওমরাহকারী হিসেবে আপনার দরবারে হাজির)। এরপর নবী (সা.) যেভাবে তালবিয়া পড়েছেন, সেভাবে তালবিয়া পড়বেন। তালবিয়া হচ্ছে
উচ্চারণ: ‘লাব্বাইক আল্লাহুম্মা লাব্বাইক। লাব্বাইকা লা-শারিকা লাকা লাব্বাইক। ইন্নাল হামদা ওয়ান নিমাতা লাকা ওয়াল মুলক। লা শারিকা লাক।’
অর্থ: আপনার দরবারে আমি হাজির হে আল্লাহ, আমি হাজির। আমি হাজির আপনার দরবারে। আপনার কোনো অংশীদার নেই। আমি আপনার দরবারে হাজির। নিশ্চয়ই সব প্রশংসা, সব নেয়ামত আপনার জন্যই এবং রাজত্ব আপনার জন্যই।
পুরুষরা উচ্চ স্বরে তালবিয়া পড়বেন। ইহরাম পরা থেকে তাওয়াফ শুরু করার আগপর্যন্ত তালবিয়া পড়ার বিধান আছে। তাওয়াফ শুরু করলে তালবিয়া পড়া ছেড়ে দেবেন।
ইহরাম অবস্থায় যা করা যাবে না
হজের মতো ওমরাহর সময়ও নিচের কাজগুলো করা নিষিদ্ধ
-সেলাইযুক্ত কাপড় বা জুতা ব্যবহার করা।
-মাথা ও মুখ ঢাকা।
-চুল কাটা বা ছিঁড়ে ফেলা।
-নখ কাটা।
-ঘ্রাণযুক্ত তেল বা আতর লাগানো।
-স্ত্রী সহবাস করা, যৌন উত্তেজনামূলক কোনো আচরণ করা।
-শিকার বা ঝগড়া-বিবাদ ও যুদ্ধ করা।
-চুল-দাড়িতে চিরুনি বা আঙুল চালনা করা, যাতে ছেঁড়ার আশঙ্কা থাকে।
-শরীরে সাবান লাগানো।
-উকুন, ছারপোকা, মশা, মাছিসহ কোনো জীবজন্তু হত্যা করা।
-যেকোনো ধরনের গুনাহের কাজ করা।
তাওয়াফ করার নিয়ম
পবিত্র কাবাঘর সাতবার প্রদক্ষিণ করাকে তাওয়াফ বলা হয়। ওমরাহকারী প্রথমেই মসজিদে হারামে ডান পা দিয়ে প্রবেশ করবেন। এ সময় বিভিন্ন দোয়ার কথা বলা হয়েছে। নিজের সুবিধামতো সেই দোয়া পড়তে পারেন। এরপর তাওয়াফ শুরুর জন্য হাজরে আসওয়াদের দিকে এগিয়ে যাবেন। ডান হাত দিয়ে হাজরে আসওয়াদ স্পর্শ করবেন এবং চুমু খাবেন। যদি হাজরে আসওয়াদে চুমু খেতে না পারেন, হাত দিয়ে স্পর্শ করবেন এবং হাতে চুমু খাবেন। যদি হাত দিয়ে স্পর্শ করতে না পারেন, তাহলে হাজরে আসওয়াদের দিকে মুখ করে হাত দিয়ে ইশারা করবেন এবং তাকবির বলবেন। কিন্তু হাতে চুমু খাবেন না।
এরপর ডানদিক ধরে চলতে থাকবেন। পবিত্র কাবাঘরকে বামদিকে রাখবেন। যখন রুকনে ইয়ামেনিতে (হাজরে আসওয়াদের পর তৃতীয় কর্নার) পৌঁছাবেন, তখন সেই কর্নার শুধু স্পর্শ করবেন। যদি স্পর্শ করা সম্ভব না হয়, তাহলে তাওয়াফ চালিয়ে যাবেন; ভিড় করবেন না। এরপর হাজরে আসওয়াদের দিকে অগ্রসর হতে হতে এ দোয়া পড়বেন
উচ্চারণ: ‘রাব্বানা আতিনা ফিদ-দুনিয়া হাসানাতাও ওয়া ফিল আখিরাতি হাসানাতাও ওয়াক্বিনা আজাবান নার।’
অর্থ: হে আমাদের রব, দুনিয়ায় আমাদের কল্যাণ দান করুন এবং আখিরাতেও কল্যাণ দান করুন এবং আমাদের জাহান্নামের আজাব থেকে রক্ষা করুন। সুনানে আবু দাউদ
যখনই হাজরে আসওয়াদের পাশ দিয়ে অতিক্রম করবেন, তখন হাজরে আসওয়াদ অভিমুখী হয়ে তাকবির বলবেন। তাওয়াফের অন্য অংশে যা কিছু খুশি জিকির, দোয়া ও কোরআন তেলাওয়াত করবেন।
ইজতেবা ও রমল করার নিয়ম
তাওয়াফের মধ্যে পুরুষদের দুটি জিনিস করতে হয়:
তাওয়াফের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত ইজতেবা করা। ইজতেবা মানে ডান কাঁধ খালি রেখে চাদরের মাঝের অংশ বগলের নিচ দিয়ে এনে চাদরের পাশ বাম কাঁধের ওপর ফেলে দেওয়া। তাওয়াফ শেষ করার পর চাদর আগের অবস্থায় ফিরিয়ে নেবেন। কারণ ইজতেবা শুধু তাওয়াফের মধ্যে করতে হয়।
তাওয়াফের প্রথম তিন চক্করে রমল করা। রমল মানে ছোট ছোট পদক্ষেপে দ্রুত হাঁটা। আর বাকি চার চক্করে রমল নেই বিধায় স্বাভাবিক গতিতে হাঁটবেন।
তাওয়াফ শেষ করার পর
সাত চক্কর তাওয়াফ শেষে মাকামে ইবরাহিমের পেছনে দুই রাকাত নফল নামাজ আদায় করবেন। নামাজের পর জমজমের পানি পান করবেন। মাতাফের (তাওয়াফ করার স্থান) চতুর্দিকে জমজমের গরম ও ঠা-া পানির ড্রাম আছে।
সাফা-মারওয়ায় সায়ি করার নিয়ম
জমজমের পানি পান করে ধীরে ধীরে সাফা পাহাড়ে আরোহণ করবেন। সাফা ও মারওয়া পাহাড় দুটি কাবা শরিফের পাশেই অবস্থিত। এরপর সায়ি করার স্থানে উপস্থিত হবেন। এরপর সাফা পাহাড়ে উঠবেন, যাতে কাবা শরিফ দেখতে পান। কাবার দিকে ফিরে আলহামদুলিল্লাহি আল্লাহু আকবার বলবেন। কাবা নজরে এলে কাবাকে সামনে রেখে দুই হাত তুলে দোয়া শেষে সায়ি শুরু করবেন। সায়ির সময় যখন সবুজ কালার চিহ্নিত স্থানে পৌঁছাবেন, তখন যত জোরে সম্ভব দৌড়াবেন। কিন্তু কাউকে কষ্ট দেবেন না। দ্বিতীয় সবুজ রঙ চিহ্নিত স্থান থেকে স্বাভাবিক গতিতে হাঁটবেন। এভাবে মারওয়াতে পৌঁছাবেন।
এরপর মারওয়া থেকে নেমে সাফার উদ্দেশে হেঁটে যাবেন। স্বাভাবিকভাবে হাঁটার স্থানে হেঁটে পার হবেন আর দৌড়ানোর স্থানে দৌড়ে পার হবেন। এভাবে সাত চক্কর শেষ করবেন। সাফা থেকে মারওয়া গেলে এক চক্কর। মারওয়া থেকে সাফাতে এলে এক চক্কর। সায়ির মধ্যে যা খুশি জিকির, দোয়া, কোরআন তিলাওয়াত করতে পারবেন। সায়ি শেষ হলে এ দোয়া পড়বেন
উচ্চারণ: ‘রাব্বানা তাক্বাব্বাল মিন্না ইন্নাকা আনতাস ছামিউল আলিম।’
অর্থ: হে আমাদের রব, আমাদের পক্ষ থেকে কবুল করুন। আপনি নিশ্চয়ই সবকিছু শোনেন ও জানেন।
মাথা মুণ্ডন বা চুল ছোট করার বিধান
সাত চক্কর সায়ি শেষ করার পর পুরুষ হলে মাথা মুণ্ডন করবেন অথবা মাথার চুল ছোট করবেন। মুণ্ডন করলে মাথার সর্বাংশের চুল মুণ্ডন করতে হবে। অনুরূপভাবে চুল ছোট করলে মাথার সর্বাংশের চুল ছোট করতে হবে। মাথা মুণ্ডন করা চুল ছোট করার চেয়ে উত্তম। মহানবী (সা.) মাথা মুণ্ডনকারীদের জন্য তিনবার এবং চুল ছোটকারীদের জন্য একবার দোয়া করেছেন। সহিহ মুসলিম : ১৩০৩
আর নারীরা আঙুলের এক কর পরিমাণ মাথার চুল কাটবেন। এভাবে ওমরাহর প্রধান চার কাজ সম্পন্ন হলেই ওমরাহ পূর্ণ হয়ে যাবে।
লিখেছেন মাওলানা ওয়ালী উল্লাহ