ছবি : বাংলাবার্তা
মানব চরিত্রে যেসব খারাপ অভ্যাস আছে- তার মধ্যে হিংসা অত্যন্ত ক্ষতিকারক। হিংসার অনলে পুড়ে ব্যক্তি জীবন, পারিবারিক ও সামাজিক জীবনে পারস্পরিক হিংসা-বিদ্বেষ, ঈর্ষাকাতরতা, দ্বন্দ্ব ও কলহ-বিবাদ মানুষের শান্তিপূর্ণ জীবনকে অত্যন্ত বিষময় ও দুর্বিষহ করে তোলে।
হিংসা হচ্ছে- ‘আল্লাহ অন্যকে যে নেয়ামত দান করেছেন তাকে হিংসা করা এবং উক্ত নেয়ামতের ধ্বংস কামনা করা।’
আর হিংসুক হলো- ‘হিংসাকৃত ব্যক্তির নেয়ামত ধ্বংসের আকাঙ্ক্ষী।’
এমনিভাবে কেউ ভালো পথে চলতে থাকলে কিংবা ভালো কোনো কাজ করতে গেলে সেখান থেকে সে ফিরে আসা, বাধাগ্রস্ত হওয়া কিংবা ব্যর্থ হওয়ার কামনা করা। এগুলোই হিংসা। এসব হচ্ছে হিংসার প্রথম ধাপ। এর একটা পর্যায় অবশ্য মানুষের পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণাধীন নয়। অনেকটাই সৃষ্টিগণ ও স্বভাবজাত। মহান আল্লাহ তো বলেই দিয়েছেন- ‘মানুষকে কৃপণতাপ্রবণ করেই সৃষ্টি করা হয়েছে।’ (সূরা নিসা, আয়াত : ১২৮)।
আরও পড়ুন : এবারের বিশ্ব ইজতেমার ম্যাপ ও খিত্তা নম্বর
এ কৃপণতার প্রভাবে মানুষ যেমন অন্য কাউকে নিজের সম্পদ দিতে চায় না, ঠিক এ কার্পণ্যের কারণেই ‘অন্য কেউ ভালো অবস্থায় থাকুক’ এটাও সে মেনে নিতে চায় না। সম্মান, পদ অথবা অর্থ আমার কাছে না এসে তার কাছে কেন? তা আমার কাছে চলে আসুক। তা যদি না হয় কমপক্ষে তার কাছ থেকে হারিয়ে যাক। এটাই হিংসা।
পবিত্র কুরআনে হিংসার ভয়াবহতা
হিংসুক সবচেয়ে বেশি ক্ষতি করে নিজেকে। অন্যকে ক্ষতি করার আগে সে নিজে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। কেননা শুরুতেই সে হিংসার আগুনে জ্বলতে থাকে। হিংসা দূর না হওয়া পর্যন্ত এটাই তার জন্য স্থায়ী দুনিয়াবী শাস্তি। তার চেহারা সর্বদা মলিন থাকে। তার সাথে তার পরিবারে হাসি ও আনন্দ থাকে না। অন্যের ক্ষতির মোহে সে সর্বদা ব্যস্ত থাকে। প্রতিপক্ষের হামলার ভয়ে সে সর্বদা ত্রস্ত ও ভীত থাকে।
নিশুতি রাতে বাঁশ ঝাড়ে কঞ্চির শব্দে জিনের ভয়ে হার্টফেল করার মত হিংসুক ব্যক্তি সর্বদা কল্পিত শত্রুর ভয়ে শংকিত থাকে। তার অন্তর সদা সংকুচিত থাকে। তারই মত শঠেরা তার বন্ধু হয়। ফলে সৎ সংসর্গ থেকে সে বঞ্চিত হয়। ঘুণ পোকা যেমন কাঁচা বাঁশকে ভিতর থেকে কুরে কুরে খায়, হিংসুক ব্যক্তির অন্তর তেমনি হিংসার আগুন কুরে কুরে খায়। এক সময় সে ধ্বংস হয়ে যায়, যেমন ঘুণে ধরা বাঁশ হঠাৎ ভেঙ্গে পড়ে যায়। এভাবে দুনিয়ায় সে এসি ঘরে শুয়ে থেকে হিংসার আগুনে জ্বলে-পুড়ে মরে। আর মৃত্যুর পরে তাকে গ্রাস করে জাহান্নামের ভয়াবহ আগুন। দুনিয়ায় সে যেমন ছিল সর্বদা মলিন চেহারার অসুখী মানুষ, আখেরাতেও সে উঠবে তেমনি মলিন চেহারায় অধোমুখি হয়ে। মহান আল্লাহ বলেন, ‘অনেক মুখমন্ডল সেদিন হবে ধূলি ধূসরিত, কালিমালিপ্ত তারা হলো অবিশ্বাসী পাপিষ্ঠ।’ (সূরা আবাসা, আয়াত : ৪০-৪২)।
তাদেরকে দেখে যেমন দুনিয়াতে চেনা যেত। আখেরাতেও তেমনি চেনা যাবে। যেমন আল্লাহ বলেন, ‘অপরাধীদের চেনা যাবে তাদের চেহারা দেখে। অতঃপর তাদেরকে পাকড়াও করা হবে কপালের চুল ও পা ধরে।’ (সূরা রহমান, আয়াত : ৪১)।
হিংসার ভয়াবহতা সম্পর্কে পবিত্র কুরআনে মহান আল্লাহ বলেন, ‘বলুন, আমি আশ্রয় গ্রহণ করছি প্রভাতের পালনকর্তার। তিনি যা সৃষ্টি করেছেন, তার অনিষ্ট থেকে। অন্ধকার রাত্রির অনিষ্ট থেকে, যখন তা সমাগণ হয়। গ্রন্থিতে ফুঁৎকার দিয়ে জাদুকারিনীদের অনিষ্ট থেকে এবং হিংসুকের অনিষ্ট থেকে যখন সে হিংসা করে।’ (সূরা : ফালাক)।
তাফসীরকারক রাজী রহ. বলেন, নিন্দনীয় ব্যক্তিদের মধ্যে সর্বোচ্চ নিন্দনীয় হচ্ছে শয়তান। এ কারণেই মহান আল্লাহ মানবীয় সকল মন্দের সমষ্টি শেষ করেছেন হিংসা দিয়ে। আর শয়তানের সকল মন্দ স্বভাবের সমষ্টি শেষ করেছেন হিংসা দিয়ে। ( মাফাতিহুল গাইব : ১/২২৬)।
হুসাইন ইবনুল ফযল রহ. বলেন, নিশ্চয় মহান আল্লাহ সকল মন্দ স্বভাব এ আয়াতে একত্রিত করেছেন। আর এ মন্দ স্বভাবের শেষ করেছেন হিংসা দ্বারা। এটা বুঝানোর জন্য, হিংসা হচ্ছে সবচেয়ে নিন্দনীয় স্বভাব। (আল কাশফু ওয়াল বয়ান লিস সা’লাবী : ১০/৩৪০)।
হাদিস শরিফে হিংসার ভয়াবহতা
হিংসুকের হিংসা কারো নিয়ামত ছিনিয়ে নিতে পারে না। হিংসাকে অগ্রাহ্য করে প্রতিনিয়ত যখন কেউ এগিয়ে চলে তখন বাড়তে থাকে হিংসার আগুন। সে আগুনে জ্বলে পুড়ে ছাই হতে থাকে হিংসুকের অন্তর। কথা হল, হিংসার আগুন কি শুধু হিংসুকের অন্তরকেই জ্বালায়? নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের হাদীস থেকে আমরা এর উত্তর পাই, ‘তোমরা হিংসা থেকে বেঁচে থেকো। কারণ হিংসা নেক আমলসমূহকে গ্রাস করে নেয়, যেভাবে আগুন গ্রাস করে লাকড়ি (অথবা ঘাস)।’ (সুনানে আবু দাউদ, হাদিস ৪৯০৫)।
লাকড়ি যেমন আগুনের সামনে অসহায়, হিংসার আগুনের সামনে মানুষের নেক আমলও তেমনি অসহায়। হিংসার আগুন গ্রাস করে নেয় ব্যক্তির যাবতীয় নেক আমল। নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরেক হাদিসে হিংসাকে তুলনা করেছেন পানির সঙ্গে। দুই হাদিসের দুই উপমা বাহ্যত বিপরীতমুখী মনে হলেও এ বিবেচনায় তো অবশ্যই এক। আগুন যেমন লাকড়ি আর ঘাসকে জ্বালিয়ে শেষ করে দেয়, পানিও তেমনি আগুনকে নিভিয়ে দেয় মুহূর্তেই। আগুনের সামনে লাকড়ি আর ঘাসের প্রাচুর্য যেমন কোনো বিবেচ্য বিষয় নয়, পানির সামনেও আগুনের বিশালতা উল্লেখ করার মতো কিছু নয়। হাদীসের ভাষ্য এমন, ‘নিশ্চয় হিংসা নেক আমলসমূহের নূর ও আলোকে নিভিয়ে দেয়।’ (সুনানে আবু দাউদ, হাদিস ৪৯০৬)।
হিংসা তাই সর্বাবস্থায় পরিত্যাজ্য। এ হিংসা কোনো মুমিনের চরিত্র হতে পারে না। হাদিসের বক্তব্য এমনই, ‘কোনো বান্দার হৃদয়ে ঈমান ও হিংসা একত্রিত হতে পারে না।’ (সুনানে নাসাঈ, হাদিস ৩১০৯)। অর্থাৎ একটি অন্তরে হয় ঈমান থাকবে, নয় হিংসা থাকবে। ঈমানদারের অন্তরে হিংসা থাকবে না, হিংসুকের অন্তরে ঈমান থাকবে না। মুমিন কখনো হিংসুক নয়, হিংসুক কখনো মুমিন নয়। অর্থাৎ পূর্ণ মুমিন নয়।
মহান আল্লাহ আমাদের সবাইকে হিংসা থেকে বেঁচে থাকার তাওফিক দান করুন। আমিন।
বাংলাবার্তা/জেডএইচ