ছবি : বাংলাবার্তা
দাওয়াত ও তাবলিগের কাজ সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়েছে। মুসলিম, অমুসলিম সর্বত্র সমান তালে চলছে দাওয়াত ও তাবলিগের কাজ। নিজের টাকায় খেয়ে- মানুষের মন জয় করে এ জামাত কাজ করে যাচ্ছে। কারো তর্ক-বিতর্ক নয় বরং মহব্বতের সাথে দাওয়াত দিয়ে যাচ্ছে।
পদ-পদবিহীন এ জামাতে দ্বিধা বিভক্ত ছিল না। তবে তাবলিগ জামাতের প্রতিষ্ঠাতা মাওলানা ইলিয়াস শাহ (রাহ.)-এর নাতি মাওলানা সাদ-এর কিছু বিতর্কিত বক্তব্য নিয়ে বিশ্ব তাবলিগ জামাত দ্বিধাবিভক্ত হয়ে পড়েছে। শত বছর আগে প্রতিষ্ঠিত বিশ্ব তাবলিগ জামাতের আমিরের দায়িত্ব পালন করেছেন মাওলানা ইলিয়াস (রাহ.) এবং এরপর আমিরের দায়িত্বে ছিলেন তার ছেলে মাওলানা হারুন (রাহ.)। মাওলানা জুবায়েরুল আহসানের ইন্তেকালের পর আমিরের দায়িত্বে আসেন মাওলানা সাদ কান্ধলভী। ইত:পূর্বে তাবলিগ জামাতের কোনো আমির বা মুরব্বির কোনো বক্তব্য নিয়ে এর আগে এতো বিতর্কের সৃষ্টি হয়নি। যেটি হচ্ছে মাওলানা সাদের দেয়া বিভিন্ন বক্তব্য নিয়ে।
মাওলানা সাদের বক্তব্যে অভিযোগ উঠেছে তিনি বিভিন্ন সময় বিভিন্ন জায়গায় কুরআন, হাদিস, ইসলাম, নবি-রাসুল ও নবুয়ত এবং মাসআলা-মাসায়েল নিয়ে আপত্তিকর বয়ান করেছেন। তার দেয়া বিতর্কিত বয়ানের কিছু অংশ তুলে ধরা হলো,
১. প্রধান অভিযোগ হলো তিনি ঐতিহ্যবাহী শুরা ভেঙে আমিরতন্ত্র কায়েম করেছেন। এ বিষয়ে তাঁর একটি বক্তব্য প্রণিধানযোগ্য। তিনি বলেছেন, ‘আল্লাহর কসম, আমি তোমাদের আমির। যে আমাকে আমির মানবে না সে জাহান্নামে যাবে।’ এরপর কয়েকবার নিজামুদ্দিন মারকাজে মারধরের ঘটনা ঘটে। পরে ২০১৫ সালের নভেম্বরে রায়বেন্ড ইজতেমায় একত্রিত হয়ে নিজামুদ্দিনের মুরব্বিরা মারকাজের সার্বিক পরিস্থিতি তুলে ধরেন এবং ১৩ জনের শুরা গঠন করা হয়। কিন্তু মাওলানা সাদ শুরা মানতে অস্বীকৃতি জানান। অতঃপর বিশেষ বাহিনীর মাধ্যমে তিনি নিজামুদ্দিন দখল করেন। তাঁর ওস্তাদসহ সব আলেমকে সেখান থেকে বের করে দেন, বের করতে গিয়ে আলেমদের শরীর থেকে রক্ত ঝরাতেও কসুর করেননি। (সূত্র: দাওয়াত ও তাবলিগ, ড. মুহাম্মদ আবদুল হাননান, বিশ্বসাহিত্য ভবন, নভেম্বর, ২০১৮ ভূমিকা দ্রষ্টব্য, পৃষ্ঠা-১৩)
২. মাওলানা সাদ বলেছেন, ‘মসজিদে ঈমানের আসর কায়েম করা ফরজ। মসজিদের বাইরে অন্য কোথাও হেদায়েত পাওয়া যাবে না।’ (সূত্র: দারুল উলুম দেওবন্দের ফতোয়া: ১৫)
৩. সাদ সাহেব বলেন, ‘হজরত মুসা (আ.) নিজের জাতির মধ্যে দাওয়াতের কাজ ছেড়ে আল্লাহ তাআলার সঙ্গে কথা বলার উদ্দেশ্যে নির্জনবাসে চলে গিয়েছিলেন। যার ফলে পাঁচ লাখ ৮৮ হাজার বনি ইসরাইল গোমরাহ হয়ে যায় (মুরতাদ হয়ে যায়)।’ (সূত্র: দারুল উলুম দেওবন্দের ফতোয়া: ১৮)
৪. মাওলানা সাদের মতে তাবলিগের ৬ নম্বরই প্রকৃত ইসলাম। সাদ সাহেব বলেন, ‘যে ব্যক্তি এই ৬ নম্বরকে পূর্ণ দীন মনে করে না, সে হলো ওই ব্যবসায়ীর মতো, যে নিজেই নিজের দধিকে টক বলে বেড়ায়। এমন ব্যবসায়ী কখনো সফল হতে পারে না।’ (সূত্র: দারুল উলুম দেওবন্দের ফতোয়া: ১৭)
৫. ‘ক্যামেরা মোবাইল পকেটে থাকলে নামাজ হবে না। ক্যামেরাযুক্ত মোবাইল থেকে দেখে দেখে কোরআন শোনা ও পড়া হারাম। এতে কোরআনের অবমাননা হয়। এর কারণে কোনো সওয়াব হবে না। যেসব আলেম তা বৈধ হওয়ার ফতোয়া দেন, তাঁরা উলামায়ে সু।’ (সূত্র: দারুল উলুম দেওবন্দের ফতোয়া: ১৬)
আরও পড়ুন : দিল্লির মাওলানা সাদের ইজতেমায় অংশগ্রহণ নিয়ে ধোঁয়াশা
৬. কুরআন পড়িয়ে অর্থ নেওয়া হারাম। তিনি বলেন, ‘বিনিময় নিয়ে কোরআনে কারিম পড়া নোংরা নারীর বিনিময়ের মতো। নোংরা নারী তার আগে জান্নাতে যাবে।’ (সূত্র: দারুল উলুম দেওবন্দের ফতোয়া: ১৬)
৭. নিজামুদ্দিন থেকে বিচ্ছিন্ন হলে ধর্মত্যাগের গুনাহ হবে। এ বিষয়ে তার বক্তব্য হলো— ‘সাহাবায়ে কেরাম (রা.) ঈমান আনয়নের পর মদিনা থেকে ফিরে নিজের এলাকায় যাওয়াকে ইরতিদাদ তথা ধর্মত্যাগ মনে করতেন। কাজেই নিজামুদ্দিন মারকাজ (তাবলিগের মূল কেন্দ্র) থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়াকে সাধারণ বিষয় মনে করো না।’ (সূত্র: অব্যাহত বিভ্রান্তিকর বয়ান, পৃষ্ঠা-২৫)
৮. ‘আসহাবে কাহাফের সঙ্গী জন্তুটি কুকুর ছিল না; বাঘ ছিল।’ (সূত্র: অব্যাহত বিভ্রান্তিকর বয়ান, পৃষ্ঠা-৪৯) তাঁর এ বক্তব্য পবিত্র কোরআনের সুরা কাহফের ১৮ নম্বর আয়াতবিরোধী।
৯. তার মতে, নিজামুদ্দিন পৃথিবীর অন্যতম পবিত্র স্থান। তিনি বলেন, ‘এই স্থানটির (নিজামুদ্দিন) সম্মান করো। সমগ্র পৃথিবীর অবস্থা হলো এমন যে মক্কা-মদিনার পরে যদি এমন কোনো সম্মানিত জায়গা থাকে, যে জায়গাকে আদর্শ মনে করতে হয়, যে জায়গার অনুসরণ করতে হয়, যে জায়গাকে মহান মনে করতে হয়, তাহলে সেটি হলো এই নিজামুদ্দিন বাংলাওয়ালি মসজিদ।’
১০. এত কিছু করেই তিনি থেমে যাননি। তিনি বদলে দেন নামাজের কাঠামোও! নামাজে কাওমা (রুকু থেকে উঠে দাঁড়ানো অবস্থায়) ও জলসায় (দুই সিজদার মাঝখানে বসা অবস্থায়) এমন সব দোয়া পাঠ করা শুরু করে দেন, যা হানাফি মাজহাব অনুসারে ফরজ নামাজে নয়; শুধু নফল নামাজে পড়া যাবে। এমন পরিবর্তনে তাবলিগ জামাতের সাথীরা বিস্মিত হলেও কেউ ‘উফ’ বলার সাহস পায়নি। একজন এ ব্যাপারে কারণ জানতে চাইলে তিনি জবাব দেন, ‘আমি মুহাম্মাদি। আমি সুন্নাহ অনুসরণ করি।’ এভাবেই তিনি তাবলিগ ও নামাজের কাঠামো বদলে দেন। (সূত্র: চৌধুরী আমানত উল্লাহ, সদস্য, মজলিশে আমেলা, মাদরাসায়ে কাশেফুল উলুম, বাংলাওয়ালি মসজিদ, নয়াদিল্লি; অনুবাদ : আবদুল্লাহ আল ফারুক, মাকতাবাতুল আসআদ, ঢাকা, ৫ আগস্ট ২০১৭)
মহান আল্লাহ তাওবাকারীকে ভালোবাসেন। পবিত্র কুরআনে বলেন, ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ তাওবাকারীদের ভালোবাসেন এবং তাদেরও ভালোবাসেন যারা পবিত্র থাকে।’ (সুরা বাকারা, আয়াত, ২২২)
নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘প্রত্যেক আদম সন্তানই পাপী। আর উত্তম পাপী হলো সে ব্যক্তি যে- (গুনাহ করে) তাওবা করে।’ (তিরমিজি)
দাওয়াত ও তাবলিগের যারা মেহনত করেন তাদের মধ্যে বিভক্তি, দ্বন্দ্ব ইসলামি শিষ্টাচার পরিপন্থী। তাই এই বিরোধ যত দ্রুত মেটানো যায় ততই মঙ্গল। ইসলামে প্রত্যেক বিষয়ে সুস্পষ্ট দিক-নির্দেশনা রয়েছে। দ্বিধা-দ্বন্দ্ব ভুলে খাঁটি তাওবা করে এক ও নেক হয়ে কাজ করা সময়ের অন্যতম দাবি। মহান আল্লাহ দাওয়াত ও তাবলিগের সাথীদের এক হয়ে দাওয়াতের কাজ করার তাওফিক দান করুন। আমিন।
বাংলাবার্তা/জেডএইচ