ছবি : বাংলাবার্তা
পৃথিবীতে স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক সবচেয়ে মধুর। প্রেমময় দাম্পত্য জীবন জান্নাতের এক টুকরো। আর মনোমালিন্য, ঝগড়ার দাম্পত্য জীবন জাহান্নামের এক টুকরো। দাম্পত্য জীবন মধুর ও ভালোবাসায় ভরে উঠে স্বামী-স্ত্রীর পরস্পরের বোঝাপড়ায়। অনেক সময় মধুর এ সম্পর্ক রূপ নেয় তিক্ততায়। পরস্পরের বিচ্ছেদ পর্যন্ত গিয়ে পৌঁছে। ইদানীং তো স্বামী-স্ত্রীর বিচ্ছেদ খুব সহজ বিষয়ে পরিণত হয়েছে।
স্বামী-স্ত্রীর বিচ্ছেদে সন্তান কার কাছে থাকবে?
মহান আল্লাহর দেয়া এক সুন্দর বন্ধন বিয়ে। দাম্পত্য জীবনের সবচেয়ে বড় নেয়ামত সন্তান। প্রেমময় দাম্পত্য জীবন সব সময় হয়ে উঠে না। প্রয়োজন হয় বিচ্ছেদের। মহান আল্লাহর কাছে সবচেয়ে অপছন্দের হালাল বিষয় হলো তালাক বা স্বামী-স্ত্রীর বিচ্ছেদ। মানুষের সবচেয়ে বড় শত্রু শয়তান আনন্দের অট্টহাসি তখনই হাসে যখন সে কোনও স্বামী-স্ত্রীর মাঝে বিচ্ছেদ ঘটাতে পারে। তাই বিয়ের আগে খুব ভালোভাবে ভেবে চিন্তে বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নেয়া উচিত। ইসলামের নির্দেশনা মেনে বিয়ে করা আবশ্যক।
আরও পড়ুন : স্বামী স্ত্রীকে ‘বোন’ বললে কি তালাক হয়ে যাবে
আমাদের সমাজে স্বামী-স্ত্রীর বিচ্ছেদের পর সন্তান কার কাছে থাকবে, ব্যয়ভার বহন করবে কে- এই নিয়ে নানা জটিলতা দেখা দেয়। মামলা কোট-কাচারি পর্যন্ত দৌঁড়াতে হয়। বছরের পর বছর চলতে থাকে এ সমস্যা।
ইসলামে রয়েছে সকল সমস্যার সুস্পষ্ট সমাধান। ইসলামে এ ব্যাপারে স্পষ্ট সমাধান রয়েছে। তালাকের পর সন্তান কার কাছে থাকবে, তার লালন-পালনের ব্যয়ভার কে বহন করবে। এ বিষয়ে সুস্পষ্ট নির্দেশনা রয়েছে ইসলামে।
স্বামী-স্ত্রীর বিচ্ছেদের পর সন্তান লালনপালন কার অধিকার?
সন্তান মা-বাবা উভয়ের। শুধু মা অথবা শুধু বাবার মাধ্যমে সন্তান পৃথিবীতে আসেনি। বংশগত দিক দিয়ে সন্তান বাবার বলে গণ্য হয়ে থাকে। তবে সন্তানের প্রয়োজন ও সুবিধা অনুযায়ী তার দায়িত্বভার মা-বাবা উভয়ের ওপরই অর্পিত।
পৃথিবীতে সন্তান জন্মের পেছনে মায়ের অবর্ণনীয় কষ্টের কথা অস্বীকার করার সুযোগ নেই। তেমনই বাবারও হাড়ভাঙা পরিশ্রম অস্বীকার করা যায় না। তবে কোনও কারণে তাদের বিচ্ছেদ হয়ে গেলে তখন সন্তানের লালন-পালনবিষয়ক জটিলতা সৃষ্টি হয়। এ ক্ষেত্রে শরিয়তের দিকনির্দেশনা হলো শিশুসন্তানের লালন-পালনের অধিকার মায়ের। অন্তত সাত বছর পর্যন্ত সে মায়ের কাছে লালিতপালিত হবে। এরপর বাবার কাছে থাকবে। বিখ্যাত সাহাবি হজরত আবদুল্লাহ ইবনে আমর (রা.) বর্ণনা করেন, একদা এক নারী বললেন, ‘হে আল্লাহর রাসুল! এই সন্তান আমার গর্ভজাত, সে আমার স্তনের দুধ পান করেছে, আমার কোল তার আশ্রয়স্থল। তার বাবা আমাকে তালাক দিয়েছেন। এখন তিনি সন্তানটিকে আমার কাছ থেকে কেড়ে নিতে চাচ্ছেন। প্রিয় নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে বললেন, তুমি অন্যত্র বিয়ে না করা পর্যন্ত তুমিই তার (লালন-পালনের) অধিক হকদার। (সুনানে আবু দাউদ, হাদিস : ২২৭৬)
অপর এক হাদিসে রসুল সা. বলেন, তোমরা উভয়ে লটারির মাধ্যমে ফায়সালা করো। কিন্তু স্বামী বললো, আমার সন্তান আমার থেকে কে কেড়ে নিবে? প্রিয় নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সন্তানটিকে লক্ষ্য করে বললেন, ‘ইনি তোমার বাবা এবং ইনি তোমার মা। সুতরাং তুমি এদের যাকে খুশি গ্রহণ করো। তখন সে তার মায়ের হাত ধরে, ফলে নারীটি তাকে নিয়ে চলে গেলো।’ (তিরমিজি, হাদিস : ২২৭৭)
আরেকটি হাদিস পাওয়া যায়, হযরত আলী রা. থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমরা মক্কা থেকে রওয়ানা হলে হামযাহ (রা.)-এর কন্যা আমাদের পিছে পিছে ছুটে এলো। হে চাচা! হে চাচা! বলে ডাক দিলো। আলী (রা.) তার হাত ধরে তাকে তুলে নিলেন। ফাতিমা (রা.)-কে এসে বললেন, এই নাও তোমার চাচার মেয়ে। অতএব ফাতিমা (রা.) তাকে গ্রহণ করলেন। বর্ণনাকারী পূর্ণ হাদিসটি বর্ণনা করে বলেন, জাফর (রা.) বলেন, সে আমার চাচার মেয়ে তার খালা আমার স্ত্রী। প্রিয় নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ মেয়েটি তার খালাকে দিলেন। বললেন, খালা মায়ের সমতুল্য। (মুসনাদে আহমদ, হাদিস : ২২৮০)
মা-বাবার বিচ্ছেদ হয়ে গেলে মায়ের শিশু-সন্তান প্রতিপালনের অধিকার রাখে একটা নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত। তবে এই সন্তানের মাহরাম নয় এমন কারো সঙ্গে মায়ের বিয়ে হলে, সন্তান লালন-পালনের অধিকার আর মায়ের থাকবে না। মায়ের পর নানী ও তার অবর্তমানে দাদী পর্যায়ক্রমে এ অধিকার লাভ করবেন।
বিখ্যাত সাহাবি হজরত আবদুল্লাহ ইবনে আমর (রা.) থেকে বর্ণিত, এক নারী প্রিয় নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বললেন, হে আল্লাহর রাসুল! আমার এই ছেলেকে আমি গর্ভে ধারণ করেছি, তাকে স্তন্যদান করেছি, এখনো আমার কোল-ই তার আশ্রয়; অথচ তার বাবা আমাকে তালাক দিয়েছে। আর এখন চাইছে, তাকে আমার কাছ থেকে ছিনিয়ে নিতে! তখন প্রিয় নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে বললেন, যতদিন তুমি বিয়ে না করো ততদিন তুমিই তার বেশি হকদার। (সুনানে আবু দাউদ, হাদিস: ২২৭০)
ফেকাহগ্রন্থ রাদ্দুল মুহতার যা ফতোয়ায়ে শামি নামে বিখ্যাত এই কিতাবের ৫ খণ্ডের ২৫৩ পৃষ্ঠায় আছে- শরিয়তের বিধান হচ্ছে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে বিচ্ছেদ হলে ছেলে সাত বছর এবং মেয়ের বয়স নয় বছর পর্যন্ত সন্তান তার মায়ের কাছে থাকবে। কিন্তু তার ভরণ পোষণের দায়িত্ব বাবার উপর।
ছেলের বয়স সাত বছরের পর আর কন্যার বয়স নয় বছরের পর সন্তানের দায়িত্ব বাবার উপর। স্ত্রী বা তার পক্ষের লোকদের উচিত নয় ছেলেকে তাদের কাছে আটকে রাখা। বরং ছেলেকে বাবার কাছে দিয়ে দেয়াই শরিয়তের বিধান। আবার মাকে দেখতে না দেয়াও শরিয়তের পরিপন্থি।
মহান আল্লাহ প্রতিটি স্বামী-স্ত্রীকে তাদের দাম্পত্য সম্পর্ক সুখময় ও প্রেমময় করার তাওফিক দান করুন। আমিন।