ছবি: বাংলাবার্তা
ইদানীং সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ঘুষের সয়লাব চলছে। ঘুষের সবচেয়ে ভয়ংকর দিক হল- এর সাথে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা কেউই এটিকে ঘুষ বলতে চান না। তারা বরং এটিকে ৫%, ১০% অফিস খরচ, বখশিশ, চা-মিষ্টি,উপরি আয়, মালপানি, খরচপাতি, পার্সেন্টিজ, সুদৃষ্টি, ডোনেশন, এক্সট্রা পারিশ্রমিক, খুশি করা, সম্মানি, ম্যানেজ, টুপাইস, কমিশন, ডিসকাউন্ট, সেলাম, ক্লিয়ারেন্স, নেগোসিয়েট ও হাদিয়া এসব নামে অভিহিত করতে বেশ স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন। একেকটি অফিস বা প্রতিষ্ঠানে এক এক নামে এটি পরিচিত। অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়, নাম বদল করে তারা এ অপরাধকে কিছুটা হালকাভাবে দেখতে চান।
ইসলামি জ্ঞানের দিকে লক্ষ্য করলে আমরা দেখতে পাই প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর কাছে একজন কর্মচারী কিছু মাল এনে বলল, এটা আপনাদের (সরকারী) মাল, আর এটা আমাকে দেয়া হাদিয়া। প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এতে তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করে বললেন, সে তার বাবা-মার ঘরে বসে থাকল না কেন, তখন সে দেখতে পেত, তাকে কেউ হাদিয়া দেয় কি-না? (সহিহ বুখারি, হেবা ও তার ফজিলত অধ্যায়)
এ থেকে বুঝা যায়, যত সুন্দর নামেই এর নামকরণ করা হোক কিংবা জনগণ খুশি হয়ে প্রদান করুক অথবা কাজের বিনিময় হিসেবে দিয়ে থাকুক, অর্পিত দায়িত্ব পালনের বিনিময়ে বেতন-ভাতা বাদে অন্যের কাছ থেকে যে অতিরিক্ত অর্থ গ্রহণ করা হয় তার সবই ঘুষ এবং অন্যায়। এতে একপক্ষ অধিক লাভবান হয় এবং অন্যপক্ষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়, যা ইসলাম ও সাধারণ বিবেক কোনটিই সমর্থন করে না। আপাতদৃষ্টিতে ঘুষকে একটি মাত্র অপরাধ মনে করা হলেও বস্তুত এটি বিভিন্ন পথ ও পন্থায় অসংখ্য অপরাধের দায়ে ঘুষখোরকে অভিযুক্ত করে কীভাবে তার ধ্বংস সুনিশ্চিত করে পবিত্র কুরআন ও সুন্নাহর আলোকে সে সম্পর্কে নিম্নে আলোচনা করা হল-
এক. জুলুমের দায়ে অভিযুক্ত
ঘুষের মাধ্যমে অন্যের প্রতি আর্থিক ও মানসিক জুলুম করা হয় বলে ঘুষখোররা জালেম হিসেবে অপরাধী। জুলুমের শাস্তি সম্পর্কে বর্ণিত হয়েছে, ‘কেবল তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা অবলম্বন করা হবে, যারা মানুষের প্রতি জুলুম করে এবং পৃথিবীতে অন্যায়ভাবে বিদ্রোহ করে বেড়ায়। তাদের জন্য রয়েছে মর্মন্তুদ শাস্তি।’ (সুরা শূরা, আয়াত : ৪২)
মহান আল্লাহ অন্যত্র বলেন, ‘যারা জুলুম করে তোমরা তাদের দিকে ঝুঁকে পড় না। পড়লে তোমাদেরকে জাহান্নামের আগুন স্পর্শ করবে। এমতাবস্থায় আল্লাহ ব্যতীত তোমাদের কোন অভিভাবক থাকবে না এবং তোমাদের সাহায্য করা হবে না।’ (সুরা হুদ, আয়াত : ১১৩)।
রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘জুলুম কিয়ামতের দিন অন্ধকার হয়ে আচ্ছন্ন করবে।’ (সহিহ বুখারি, মিশকাত হাদিস : ৫১২৩ জুলুম অনুচ্ছেদ)
হাদিসে কুদসিতে এসেছে, আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘হে আমার বান্দারা! আমি আমার নিজের জন্য জুলুমকে হারাম করেছি এবং তোমাদের মধ্যেও সেটিকে হারাম গণ্য করেছি। সুতরাং তোমরা পরস্পর জুলুম করো না।’ (সহিহ মুসলিম, হাদিস : ২৫৭৭)
দুই. ঘুষখোর হারাম ভক্ষণকারী
আল্লাহ তায়ালা বলেন,‘তোমরা একে অন্যের সম্পদ অন্যায়ভাবে ভক্ষণ করো না।’ (সুরা বাকারা, আয়াত : ১৮৮)
রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘নিশ্চয়ই যারা অন্যায়ভাবে আল্লাহর সম্পদ আত্মসাৎ করবে, কিয়ামতের দিন তাদের জন্য নির্ধারিত রয়েছে জাহান্নাম।’ (সহিহ বুখারি, মিশকাত, হাদিস : ৩৯৯৫, নেতৃত্ব ও বিচার-ফায়ছালা অধ্যায়, কর্মচারীদের বেতন নেওয়া ও উপঢৌকন গ্রহণ করা অনুচ্ছেদ)
তিনি আরও বলেন, ‘হারাম খাদ্য দ্বারা গঠিত শরীর জান্নাতে প্রবেশ করবে না।’ (শুয়াবুল ঈমান, মিশকাত, হাদিস : ২৭৮৭)
আরও পড়ুন : নবীজি (সা.)-এর ভালোবাসায় পাহাড়, পাথর, গাছের সালাম
তিন. ঘুষখোর খিয়ানতকারী
রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘আমি যাকে ভাতা দিয়ে কোন কাজের দায়িত্ব প্রদান করেছি, সে যদি ভাতা ব্যতীত অন্য কিছু গ্রহণ করে তাহলে তা হবে আমানতের খিয়ানত।’ (আবু দাউদ, হাদিস : ২৯৪৩)
আল্লাহ বলেন, ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ আমানতের খিয়ানতকারীদের পসন্দ করেন না’ (সুরা আনফাল, আয়াত : ৫৮)
‘আমানতের খিয়ানত মুনাফেকির একটি অন্যতম আলামত।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস : ৩৩, ঈমান অধ্যায়, মুনাফিকের আলামত অনুচ্ছেদ)
আর মুনাফিকের শাস্তি জাহান্নাম। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘নিশ্চয়ই মুনাফিকরা জাহান্নামের সর্বনিম্ন স্তরে অবস্থান করবে। আর তুমি তাদের কোন সাহায্যকারী পাবে না।’ (সুরা নিসা, আয়াত : ১৪৫)
চার. ঘুষখোর নিরীহ মাজলুমদের বদদোয়ার শিকার
রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘তুমি মাজলুমের বদদোয়া থেকে বেঁচে থাক। কেননা মাজলুমের বদদোয়া ও আল্লাহর মাঝে কোনো পর্দা নেই।’ (সহিহ বুখারি, মিশকাত, হাদিস : ১৭৭২, যাকাত অধ্যায়)
মাজলুমের দোয়া ব্যর্থ হয় না। তাছাড়া কিয়ামতের দিন অন্যের সম্পদ ভক্ষণকারী জালিমের নিকট থেকে তার নেকি হতে মাজলুমের বদলা পরিশোধ করা হবে। নেকী শেষ হয়ে গেলে মাজলুমের পাপ জালিমের উপর চাঁপানো হবে। পরিশেষে তাকে নিঃস্ব অবস্থায় জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে। (সহিহ বুখারি, মিশকাত, হাদিস : ৫১২৬)
পাঁচ.ঘুষ কিয়ামতের দিন বিপদের বোঝা হয়ে ঘুষখোরের কাঁধেই চেঁপে বসবে
রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কর্তৃক নিয়োগপ্রাপ্ত জনৈক কর্মচারীর হাদিয়া গ্রহণের কথা শুনে এর তীব্র প্রতিবাদ জানিয়ে তিনি ঘোষণা দিলেন, ‘সেই সত্তার কসম, যার হাতে আমার প্রাণ! সাদাকার মাল হতে স্বল্প পরিমাণও যে আত্মসাৎ করবে, সে তা কাঁধে নিয়ে কিয়ামত দিবসে উপস্থিত হবে। সেটা উট হলে তার আওয়াজ করবে, গাভী হলে হাম্বা হাম্বা শব্দ করবে এবং বকরি হলে ভ্যাঁ ভ্যাঁ করতে থাকবে।’(সহিহ বুখরি, হাদিস : ২৫৯৭)
হযরত সাওবান রা. থেকে বর্ণিত- ‘ রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ঘুষদাতা, ঘুষগ্রহীতা এবং উভয়ের মধ্যে যোগাযোগ স্থাপনকারী সকলকেই অভিসম্পাত করেছেন।’ (মুসনাদে আহমদ)
অন্য হাদিসে বলা হয়েছে- اَلرَّاشِىْ وَالْمُرْتَشِىْ فِى النَّارِ ‘ঘুষদাতা ও ঘুষগ্রহীতা জাহান্নামী হবে।’
মহান আল্লাহ আমাদের সবাইকে ঘুষ গ্রহণ, ঘুষ দাতা ও ঘুষের সহযোগীতা থেকে বিরত রাখুন। আমিন।
বাংলাবার্তা/জেডএইচ